তস্মৈ স হোবাচ প্রজাকামো বৈ প্রজাপতিঃ স তপোঽতপ্যত স তপস্তত্ত্বা
স মিথুনমুৎপাদয়তে। রয়িং চ প্রাণং চেত্যেতৌ মে বহুধা প্রজাঃ
করিষ্যত ইতি॥৪
অন্বয়: সঃ (তিনি) [পিপ্পলাদ]; তস্মৈ (তাঁকে) [কবন্ধীকে]; উবাচ (বললেন); সঃ প্রজাপতিঃ (সেই তিনি [যিনি] সমস্ত প্রাণীর প্রভু); প্রজাকামঃ (সন্তান কামনা করে); সঃ তপঃ অতপ্যত (তিনি তপস্যা করলেন [অর্থাৎ তিনি বিষয়টি চিন্তা করলেন]); তপঃ তপ্ত্বা (তপস্যা সম্পূর্ণ করে [অর্থাৎ বিষয়টি সবিশেষ চিন্তা করে]); এতৌ মে বহুধা প্রজাঃ করিষ্যতঃ (এই উভয়েই আমাকে বহু সন্তান সৃষ্টিতে সাহায্য করবে); ইতি [মত্বা] (এইরকম মনে করে); রয়িং চ প্রাণং চ (চন্দ্র [অন্নের প্রতীক] এবং সূর্য [অথবা অগ্নি, ভোক্তার প্রতীক]) মিথুনম্ উৎপাদয়তে (এই উভয়ে উৎপাদন করবে)।
সরলার্থ: পিপ্পলাদ তাঁকে বললেন—প্রজাপতির সন্তান সৃষ্টি করার ইচ্ছে হল। সেই উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যদি অন্ন [চন্দ্র বা রয়ি] থাকেন এবং সেই অন্ন গ্রহণ করার একজন ভোক্তা [সূর্য] থাকেন, তবে তাঁরা সম্মিলিতভাবে বহু সন্তান সৃষ্টি করতে পারবেন।
ব্যাখ্যা: প্রজাপতি শব্দটির অর্থ ‘জগতে সব কিছুর প্রভু বা পিতা’। ‘পতি’ শব্দের অর্থ ‘প্রভু’ বা ‘পিতা’ এবং ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ ‘যা সৃষ্টি হয়েছে’, ‘যা জন্মেছে’ অথবা ‘যার অস্তিত্ব আছে’। প্রজাপতি পরম সত্য নন। যে কেউ প্রজাপতি হতে পারেন। প্রজাপতি একটি পদ। যে-কোন ব্যক্তি নিজেকে উন্নত করে এই পদ লাভ করতে পারেন। ধরা যাক, কেউ এ-জীবনে কঠোর তপস্যা করে কিছু শক্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু ব্রহ্মকে লাভ করতে পারেননি। পরজন্মে হয়তো তিনি প্রজাপতি হলেন। তখন তাঁর মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টির বীজ নিহিত থাকবে। প্রজাপতিকে হিরণ্যগর্ভ এবং ব্রহ্মাও বলা হয়।
হিন্দুরা নতুন নতুন ‘যুগ’ বা ‘কল্পে’র ধারণায় বিশ্বাসী। প্রতি যুগে কত কিছু আসে যায়। কিন্তু কল্পান্তে সব কিছু আবার তার উৎসে মিলিয়ে যায় অর্থাৎ বীজাকারে ফিরে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একজন বুড়ীর উপমা দিতেন। সেই বুড়ী সব জিনিসের বীজ কুড়িয়ে একটা ঝুড়িতে সংগ্রহ করে রাখেন। সময় হলে সেগুলি মাটিতে ছড়িয়ে দেন। সেই বীজ থেকে অঙ্কুর হয়ে গাছ জন্মায়। গাছ বড় হয়, ফল দেয়, তারপর একদিন মরে যায়। কিন্তু গাছগুলি মরে যাবার আগেই বুড়ী আবার সেই গাছের বীজ কুড়িয়ে ঝুড়িতে তুলে রাখেন এবং ঠিকসময়ে আবার তা মাটিতে ছড়িয়ে দেন। সেই বীজ থেকে আবার গাছ হয়।
জীবনও এইভাবে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে—জন্ম থেকে মৃত্যু, আবার মৃত্যু থেকে জন্ম; কারণ থেকে কার্য, আবার কার্য থেকে কারণ। প্রাণের বিনাশ বলে কিছু নেই। প্রাণ সবসময় আছে, যদিও তা কারণরূপে বা বীজাকারেও থাকতে পারে।
বেদান্তমতে, সবকিছু এমনকি প্রজাপতিও ব্রহ্ম থেকে এসেছেন। কিন্তু ব্রহ্ম কিছু সৃষ্টি করেন না। ব্ৰহ্ম নির্গুণ অর্থাৎ কোন গুণ দ্বারা তাঁকে বিশেষিত করা যায় না; এবং তিনি নিরাকার অর্থাৎ তাঁর কোন রূপ নেই। সৃষ্টির কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাও তাঁর নেই। তাঁর যদি কোন আকাঙ্ক্ষা থাকত তাহলে তিনি নির্গুণ হতেন না। কাজেই প্রজাপতির স্থান ব্রহ্মের এক ধাপ নীচে।
প্রজাপতি কিভাবে সৃষ্টি করেন? হিন্দুদের ধারণা এই জগৎ কারোর সৃষ্টি নয়, প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। কুম্ভকার যেভাবে ঘট সৃষ্টি করে সেভাবে এ জগৎ সৃষ্টি হয়নি। প্রজাপতি থেকে এই জগৎ প্রকাশিত হয় আবার প্রজাপতিতেই ফিরে যায়। কিন্তু জগৎকে প্রকাশের জন্য প্রজাপতি কোন চেষ্টা করেন না। তিনি কেবল সঙ্কল্প করেন অর্থাৎ গভীরভাবে চিন্তা করেন। তাঁর সৃষ্টির সঙ্কল্প থেকেই সূর্য ও চন্দ্র (প্রাণ এবং রয়ি), এই যুগল বস্তু প্রকাশিত হয়। চন্দ্র অর্থাৎ রয়ি হল অন্ন বা খাদ্য। আবার চন্দ্রই আর্দ্রতা। এই আর্দ্রতা গাছ এবং অন্যান্য প্রাণীদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আবার যদি অন্ন থাকে, সেই অন্নের ভোক্তাও থাকবে। সূর্য (প্রাণ) হল সেই ভোক্তা। আবার সূর্যই প্রাণ।
বেদান্তমতে প্রাণের প্রকাশ ত্রিবিধ: সূর্য, অগ্নি যা আমরা জ্বালাই (ভূতাগ্নি) এবং আর এক প্রকার অগ্নি যা আমাদের শরীরের ভেতরে আছে (অর্থাৎ জঠরাগ্নি)। এই জঠরাগ্নি আমাদের খাদ্যবস্তু হজমে এবং দেহধারণে সাহায্য করে। রয়ি (অন্ন বা চন্দ্র) এবং প্রাণ (সূর্য) পরস্পরকে ধারণ করে আছে। কিন্তু প্রাণ এবং রয়ি দুটি পৃথক বস্তু নয়; তাদের পার্থক্য শুধু নাম আর রূপে।