ওঁ সুকেশা চ ভারদ্বাজঃ শৈব্যশ্চ সত্যকামঃ সৌর্যায়ণী চ গার্গ্যঃ
কৌসল্যশ্চাশ্বশায়নো ভার্গবো বৈদর্ভিঃ কবন্ধী কাত্যায়নস্তে হৈতে
ব্রহ্মপরা ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ পরং ব্রহ্মান্বেষমাণা এষ হ বৈ তৎ সর্বং বক্ষ্যতীতি
তে হ সমিৎপাণয়ো ভগবন্তং পিপ্পলাদমুপসন্নাঃ॥১
অন্বয়: ভারদ্বাজং সকেশা (ভরদ্বাজপুত্র সকেশা); শৈব্যঃ সত্যকামঃ চ (এবং শিবিপুত্র সত্যকাম); সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ চ (গর্গগোত্রীয় সূর্যপৌত্র); আশ্বলায়নঃ কৌসল্যঃ চ (এবং অশ্বলপুত্র কৌসল্য); বৈদর্ভিঃ ভার্গবঃ (বিদর্ভ দেশীয় ভৃগুতনয়); কাত্যায়নঃ কবন্ধী (কত্যতনয় কবন্ধী); তে হ এতে (এঁরা সকলে); ব্রহ্মপরাঃ (ব্রহ্মে সমর্পিত); ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ (ব্রহ্মে একাগ্র); পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ (পরব্রহ্মকে জানতে ইচ্ছুক হয়ে); এষঃ হ বৈ (ইনি সেই ব্যক্তি); তৎ সর্বং বক্ষ্যতি (যিনি আমাদের সেই সব শিক্ষা দেবেন); ইতি (এভাবে স্থির করে); তে (তাঁরা); সমিৎপাণয়ঃ (যজ্ঞের কাঠ হাতে নিয়ে); ভগবন্তং পিপ্পলাদম্ উপসন্নাঃ (পিপ্পলাদের নিকট উপস্থিত হলেন)।
সরলার্থ: ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা, শিবিপুত্র সত্যকাম, গর্গগোত্রীয় সৌর্যায়ণী অশ্বলপুত্র কৌসল্য, বিদর্ভদেশীয় ভৃগুপুত্র ভার্গব, কত্যতনয় কবন্ধী—এঁরা সকলেই ছিলেন ব্রহ্মে সমর্পিত প্রাণ। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু তাঁরা জানতেন না। ব্রহ্মকে তাঁরা সম্যক্ ভাবে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা সকলে যজ্ঞের কাঠ হাতে নিয়ে গুরু পিপ্পলাদের নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁরা জানতেন গুরু পিপ্পলাদ তাঁদের ব্রহ্ম বিষয়ে জ্ঞান দিতে সক্ষম।
ব্যাখ্যা: এই উপনিষদের আরম্ভ ছয়জন যুবককে নিয়ে। এই ছয়জন যুবক হলেন: সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়ণী, কৌসল্য, ভার্গব এবং কবন্ধী। তাঁরা হয়তো কেউ ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন। ভারতীয় ধারণায় সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা আসল তা হল তাঁদের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান।
উপনিষদ তাঁদের ‘ব্রহ্মপরাঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্মে নিবেদিত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের ‘ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ’ এবং ‘পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ’ বলা হয়েছে। ‘ব্রহ্মনিষ্ঠাঃ’র অর্থ একান্ত ভাবে যাঁরা ব্রহ্মে অনুরাগী এবং ‘পরং ব্রহ্ম অন্বেষমাণাঃ’ হল পরব্রহ্মকে যাঁরা জানতে আগ্রহী। এঁরা সবাই ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। বেদান্তসারে বলা হয়েছে, যখন এরকম ব্যাকুলতা জাগে তখন মনে হয় সারা শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। গায়ে আগুন লাগলে যেমন একটিই মাত্র চিন্তা থাকে কেমন করে একটু জল পাওয়া যায়, এঁদের ব্যাকুলতাও ছিল তেমনি একমুখী। শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একজন মানুষের মাথা যদি জোর করে জলের নীচে ডুবিয়ে দেওয়া যায় তবে নিঃশ্বাস নেবার জন্য তার প্রাণ আঁকুপাঁকু করবে। ব্রহ্মের জন্যও এইরকম তীব্র ব্যাকুলতার নামই ব্ৰহ্মনিষ্ঠা।
আমাদের মনোভাব কি রকম হওয়া উচিত কঠোপনিষদে নচিকেতার উপাখ্যান তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। একটি মাত্র বিষয়ে নচিকেতার আগ্রহ। তা হল আত্মাকে জানা। যম তাঁকে নানা ভাবে পরীক্ষা করছেন। তিনি বলছেন, ‘হে বালক, মৃত্যুর পরে মানুষের কি হয় তা জেনে তুমি কি করবে? তোমার বয়স অল্প, এখনও অনেক বছর বাঁচবে। জীবনটাকে তুমি উপভোগ কর। আমি তোমাকে সাহায্য করব। ধন-সম্পদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আমোদ-আহ্লাদ, যা তুমি চাইবে সব পাবে। কিন্তু তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করো না।’ কিন্তু নচিকেতা ব্রহ্মনিষ্ঠ, তাঁর মন ব্রহ্মে স্থির। নচিকেতা উত্তর দিলেন: ‘ধনরত্ন, দীর্ঘ আয়ু, আমোদ-আহ্লাদ এসব আমার দরকার নেই। ওসব আপনারই থাক। মৃত্যুর পরে মানুষের কি গতি হয় আমি শুধু সেকথাই জানতে চাই। আমি আত্মতত্ত্ব জানতে ইচ্ছুক।’
এই উপনিষদে যে ছয়জন শিক্ষার্থীর নাম করা হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই সগুণ ব্রহ্মের কথা জানতেন। এখন তাঁরা পরব্রহ্ম অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্মের কথা জানতে আগ্রহী। এইজন্য তাঁরা ঋষি পিপ্পলাদের নিকটে যাওয়া স্থির করলেন। কেননা তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, ব্রহ্ম বিষয়ে যা কিছু জানবার আছে পিপ্পলাদ তাঁদের শেখাতে পারবেন। গুরুকে ভগবান বলা হয়, কারণ তিনি নানা গুণের অধিকারী। শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী এই ছয়জন যুবক যজ্ঞের জন্য শুকনো কাঠ হাতে নিয়ে, ‘সমিৎপাণয়ঃ’, গুরুর নিকট উপস্থিত হলেন। সেই কালে যজ্ঞকর্মের জন্য গুরুর জ্বালানী কাঠের প্রয়োজন হত। গুরুর প্রতি এই অর্ঘ্যটুকু শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধা, বিনয় এবং শিক্ষালাভের জন্য তীব্র আগ্রহের প্রতীক।