অথোত্তরেণ তপসা ব্রহ্মচর্যেণ শ্রদ্ধয়া
বিদ্যায়াঽঽত্মানমম্বিষ্যাদিত্যমভিজয়ন্তে।
এতদ্বৈ প্রাণানামায়তনমেতদমৃতমভয়মেতৎ
পরায়ণমেতস্মান্ন পুনরাবর্তন্ত ইত্যেষ নিরোধস্তদেষ শ্লোকঃ॥১০
অন্বয়: অথ (কিন্তু [অনেকে আছেন যাঁরা]); তপসা ব্রহ্মচর্যেণ (কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মসংযম অভ্যাসের দ্বারা); শ্রদ্ধয়া ([গুরু এবং শাস্ত্রের প্রতি] বিশ্বাসের দ্বারা); বিদ্যয়া (শাস্ত্র অধ্যয়ন করে); আত্মানম্ অন্বিষ্য (আত্মাকে জানতে চেয়ে); উত্তরেণ [মার্গেন] (উত্তরপথ অনুসরণ করে); আদিত্যম্ অভিজয়ন্তে (সম্পূর্ণভাবে আদিত্যের পদ লাভ করে); এতৎ বৈ প্রাণানাম্ আয়তনম্ (ইনি সকল প্রাণের আশ্রয়); এতৎ অমৃতম্ অভয়ম্ (ইনি, অমৃত, অভয়); এতৎ পরায়ণম্ (সর্বোত্তম অবস্থা লাভ করে); এতস্মাৎ ন পুনঃ আবর্তন্তে (মর্তে আর ফিরে আসতে হয় না); এষঃ নিরোধঃ (এই হল [যাত্রার] শেষ); তৎ এষঃ শ্লোকঃ ([সেই বিষয়ে] এই শ্লোক আছে)।
সরলার্থ: কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মসংযম অভ্যাস করেন এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শাস্ত্রে ও গুরুবাক্যে তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। এইসকল গুণের অধিকারী হয়ে তাঁরা আত্মার অনুসন্ধান করেন। এই আত্মাই হলেন সূর্য। মৃত্যুর পরে এইসব মানুষ উত্তরমার্গ অনুসরণ করেন এবং কালে আদিত্যপদ লাভ করেন। আদিত্য সকল প্রাণীর আশ্রয়। আদিত্যপদ প্রাপ্ত হলে মানুষ অমর হয়, অভয়পদ লাভ করে। এই হল মানুষের সর্বোত্তম অবস্থা। একবার এই অবস্থা লাভ হলে কেউ আর এই মর্তজগতে ফিরে আসে না। এখানেই যাত্রা শেষ। এই বিষয়ে একটি শ্লোক আছে।
ব্যাখ্যা: ‘আত্মানম্ অন্বিষ্য’—‘আত্মাকে জানতে চেয়ে’। আমরা প্রত্যেকেই বলি ‘আমি’ ‘আমি’। কিন্তু এই ‘আমি’টি কে? এর দ্বারা কাকে বোঝান হয়? এই জগতের সব কিছু হয়তো আমরা জানি, কিন্তু নিজেকে জানি না। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা শুধু আত্মাকেই জানতে চান। তাঁরা সত্যের অনুসন্ধান করে চলেছেন। অবিনাশী বা চিরন্তন কিছু আছে কি না তা-ই তাদের জিজ্ঞাসা। ভোগের ইচ্ছা তাঁদের নেই, শুধু জ্ঞানলাভই উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন হল, কি উপায়ে আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব? উপনিষদ বলেন, ‘তপস্যা ও কৃচ্ছ্রসাধনার দ্বারা’। বুদ্ধের জীবন কৃচ্ছ্রসাধনা এবং দৃঢ়সঙ্কল্পের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। বহু বছর গভীর ধ্যান-চিন্তা অভ্যাস করার পর তিনি একটি গাছতলায় বসে শপথ নিলেন, ‘আমার দেহ শুকিয়ে যাক, চামড়া খসে পড়ুক, তথাপি যতদিন সেই দুঃসাধ্য বোধিলাভ না হয় এই আসন ত্যাগ করব না।’
উপনিষদ বলেন, যিনি আত্মাকে জানতে চান তাঁকে ব্রহ্মচর্য, মিতাচার এবং আত্মসংযম অবশ্য পালন করতে হবে। এর সঙ্গে অপরিহার্য হল গুরুবাক্য ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। সাধক যদি এগুলিকে অস্বীকার করেন তাহলে তাঁর পক্ষে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।
সূর্য যেহেতু জ্ঞানের প্রতীক, যাঁরা জ্ঞানের পূজারী তাঁরা মৃত্যুর পরে সূর্যের পথ অনুসরণ করেন। ‘এতৎ বৈ প্রাণানাম্ আয়তনম্’—সূর্যই প্রাণীদের আশ্রয়। তিনি অমৃত, অবিনাশী এবং নিত্য। চাঁদ কিন্তু সবসময় বদলাচ্ছে। একদিন পূর্ণচন্দ্র, তারপর দিনে দিনে ছোট হতে থাকে। কিন্তু সূর্যের কোন ক্ষয়-বৃদ্ধি নেই, সবসময় একরকম।
‘অভয়ম্’ অর্থাৎ ‘ভয়কে অতিক্রম করা’। আমরা যদি মৃত্যুর অধীন হই তবে মৃত্যুভয় সবসময় আমাদের তাড়া করে বেড়াবে। কিন্তু যদি জানি, ‘আমি দেহ নই, আত্মা যা শাশ্বত এবং অমর’—তখন বুঝতে পারি আমার মৃত্যু হতে পারে না। তখনই আমরা সম্পূর্ণ নির্ভয় হই।
তখন ‘পরায়ণম্’ অর্থাৎ পরাগতি বা ব্রহ্মলোক লাভ হয়। ‘এতস্মাৎ ন পুনঃ আবর্তন্তে’—সেখান থেকে আর কখনও ফিরে আসতে হয় না। একেই বলে মোক্ষলাভ।
সুতরাং উপনিষদ বলেন—আমরা কি চাই এবং আমাদের উদ্দেশ্য কি সে সম্পর্কে নিজেদের মনে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। আমরা কি করছি এবং কেন করছি সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই হবে আধ্যাত্মিক অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের পূজা করছি’ এই বুদ্ধিতে সব কাজ করতে হবে। এভাবেই আমরা আমাদের চরম লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারি। উপনিষদ আমাদের ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্যের দিকে চালনা করছেন।