আমরা যাতে ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ কিছুটা বুঝতে পারি সেইজন্য উপনিষদ এখানে একটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন। আমরা শক্তির প্রকাশ দেখি, কিন্তু এই শক্তির উৎস কি? ব্রহ্ম। জগতে যতকিছু শক্তি আছে ব্রহ্মই সেই সবের উৎস। আলোচ্য কাহিনীর মধ্য দিয়ে সেই তত্ত্বটিকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
একবার দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে দেবতারা জয়ী হন এবং নিজেদের শক্তিতেই এই বিজয় সম্ভব হয়েছে মনে করে খুব গর্ববোধ করতে থাকেন। বস্তুত ব্রহ্মের জন্যই এই জয় সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু দেবতারা সেকথা জানতেন না। ব্রহ্ম তাই দেবতাদের দর্প চূর্ণ করতে চাইলেন।
বিজয়োল্লাসে মত্ত দেবতারা যখন পরস্পরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাঁদের সামনে এক অদ্ভুত মূর্তির আবির্ভাব। তিনি যে কে তা দেবতারা বুঝতে পারলেন না। তাই প্রথমে তাঁরা অগ্নিকে ঐ মূর্তির কাছে গিয়ে তাঁর পরিচয় জেনে আসতে বললেন। অগ্নি তো গেলেন। কিন্তু মূর্তির কাছাকাছি আসতেই তিনি অগ্নিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’ অগ্নি বললেন, ‘আমি অগ্নি।’ মূর্তিটি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি করতে পারেন?’ অগ্নি বললেন, ‘আমি সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারি।’ অগ্নির এই কথা শোনামাত্র সেই মূর্তি একটি তৃণখণ্ড অগ্নির সামনে রেখে বললেন, ‘এটিকে পোড়ান দেখি।’ অগ্নি বারবার চেষ্টা করেও সেটিকে পোড়াতে পারলেন না। লজ্জিত হয়ে দেবতাদের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি ওঁর পরিচয় জানতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই জানতে পারলাম না।
এরপর দেবতারা পবনদেব অর্থাৎ বায়ুকে পাঠালেন। তিনি কাছে যেতেই মূর্তিটি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’ বায়ু উত্তর দিলেন, ‘আমি বায়ু।’ মূর্তিটি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি করতে পারেন?’ বায়ু বললেন, ‘আমি সব কিছু উড়িয়ে দিতে পারি।’ মূর্তিটি তখন সেই একই তৃণখণ্ড বায়ুর সামনে রেখে বললেন, ‘বেশ তো, এই তৃণখণ্ডটিকে উড়িয়ে দিন দেখি।’ বারবার চেষ্টা করেও বায়ু তৃণখণ্ডটিকে একচুল নড়াতে পারলেন না। তখন লজ্জিত হয়ে বায়ুও ফিরে গেলেন। অবশেষে মূর্তিটির পরিচয় জানতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু তিনি মূর্তিটির কাছে পৌঁছবার আগেই সেই মূর্তি অদৃশ্য হলেন এবং তাঁর জায়গায় আবির্ভূতা হলেন পরমা সুন্দরী, সালঙ্কারা এক দেবী। তিনি উমা হৈমবতী। ইন্দ্র তাঁকে অদ্ভুত মূর্তিটির পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় উমা জানালেন, উনি ব্রহ্ম। উমা আরও বললেন, ব্রহ্মের জন্যই দেবতারা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন। তখন ইন্দ্র বুঝতে পারলেন যে, দেবতাদের নিজেদের কোন শক্তি নেই, ব্রহ্মের শক্তিতেই তাঁরা শক্তিমান। দেবদেবী এবং যেখানে যত কিছু শক্তি আছে সকলের একটাই উৎস। তিনি ব্রহ্ম।’
ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে তস্য হ
ব্ৰহ্মণো বিজয়ে দেবা অমহীয়ন্ত।
ত ঐক্ষন্তাস্মাকমেবায়ং বিজয়োঽস্মাকমেবায়ং
মহিমেতি॥১
অন্বয়: ব্রহ্ম হ (প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মই, একমাত্র); দেবেভ্যঃ (দেবতাদের পক্ষে); বিজিগ্যে (জয়লাভ করেছিলেন); তস্য হ (সেটা নিশ্চিতভাবে তাঁরই [অর্থাৎ সে জয় অবশ্যই ছিল তাঁর]); ব্ৰহ্মণঃ বিজয়ে (ব্রহ্মের বিজয়ে); দেবাঃ অমহীয়ন্ত (দেবতারা গর্ব বোধ করেছিলেন); তে ঐক্ষন্ত (তাঁরা ভেবেছিলেন); অস্মাকম্ এব (বস্তুত আমাদেরই); অয়ং বিজয়ঃ (এই জয়); অস্মাকম্ এব অয়ং মহিমা ইতি (এই কৃতিত্ব কেবল আমাদেরই)।
সরলার্থ: দেবতাদের পক্ষে স্বয়ং ব্রহ্মই এই যুদ্ধ জয় করেছিলেন। এই জয় ব্রহ্মেরই, কিন্তু এই জয় নিজেদের মনে করে দেবতারা অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা ভাবলেন, ‘এ জয় আমাদেরই—এর সব কৃতিত্ব আমাদের প্রাপ্য।’
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মের কাছ থেকে পাওয়া শক্তিতেই দেবতারা যুদ্ধে জয়ী হন; কিন্তু তাঁরা মনে করেছিলেন যে, নিজেদের শক্তিতেই তাঁরা যুদ্ধে জিতেছেন। তাই এই জয় তাঁদের অহঙ্কারী করেছিল, এবং তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন এর কৃতিত্ব সম্পূর্ণ তাঁদেরই।