প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম্॥৪
অন্বয়: প্রতিবোধ-বিদিতম্ (ব্যক্তিচেতনার সর্বস্তরে জ্ঞাত); [প্রতিবোধ (প্রতিটি চেতনা, প্রতিটি মানসিক অভিজ্ঞতা)]; মতম্ ([সম্যক্ রূপে] জ্ঞাত); হি (কেননা); বিন্দতে (লাভ করেন); অমৃতত্বম্ (অমরত্ব, যা জন্মমৃত্যুর অতীত); আত্মনা (আত্মার সাহায্যে [অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের দ্বারা]); বিন্দতে (লাভ করেন); বীর্যম্ (শক্তি); বিদ্যয়া (জ্ঞানের দ্বারা [অর্থাৎ, আত্মজ্ঞানের দ্বারা, স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা]); বিন্দতে (লাভ করেন); অমৃতম্ (অমরত্ব)।
সরলার্থ: যখন কেউ ব্রহ্মকে চেতনার সর্বস্তরে, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন তখন তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন এবং জন্মমৃত্যুর পারে চলে যান। আত্মজ্ঞানের দ্বারা মানুষ শক্তি অর্জন করে; প্রকৃত জ্ঞান লাভ করলে মানুষ অমর হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা: মণিমালার প্রতিটি রত্ন যেমন একই সুতোয় গাঁথা, ঠিক তেমনি চৈতন্য (বুদ্ধি) রূপে ব্রহ্মও আমাদের সকল মানসিক অভিজ্ঞতার সর্বস্তরে বিরাজ করছেন। যেমন ধরা যাক, ঘরে একটি প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের ভিতরে হয়তো অনেক জিনিসপত্র আছে। কিন্তু সবকিছুই ঐ এক প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত। ঠিক তেমনি মন, তা সে যে কাজই করুক না কেন, সর্বসময় ব্রহ্ম বা চৈতন্যের আলোয় আলোকিত। ব্রহ্ম না থাকলে আমরা কোনকিছুই অনুভব করতে পারতাম না, কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। কিন্তু ব্রহ্ম ব্রহ্মই আছেন; সর্বদাই এক এবং অপরিবর্তনীয়। আমাদের সব মানসিক অভিজ্ঞতার নেপথ্যে তিনি আছেন, অথচ তিনি নির্লিপ্ত—আমাদের কোন অভিজ্ঞতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। যখন আমরা এই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করি, তখন আমরা অমর হয়ে যাই।
ভাবটা হচ্ছে, আমাদের অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের আত্মা অপরিবর্তনীয়। সিনেমার পর্দার উপমাটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। পর্দাটি সব অবস্থায় স্থির, অপরিবর্তিত। তার ওপর প্রতি মুহূর্তে কত রকমের ছবি ফেলা হচ্ছে, কিন্তু পর্দা পর্দাই আছে, তার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। ঠিক তেমনিভাবে পরমাত্মা আমাদের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঘূর্ণায়মান স্রোতের পিছনে নির্লিপ্ত দ্রষ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর কোন বিকার নেই। তিনি অপরিবর্তনীয়, সবকিছুর সাক্ষী-মাত্র।
এই উপনিষদ আরও বলছেন, যখন কেউ তার প্রকৃত স্বরূপ, তার আত্মাকে জানে, তখন সে ‘বীর্য’ তথা শক্তির অধিকারী হয়। সাধারণত আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার দাস। ভাল অভিজ্ঞতা হলে আমরা সুখী, আর মন্দ অভিজ্ঞতা হলে দুঃখী—এই আমাদের অবস্থা। এরকম হওয়ার কারণ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমরা নিজেদের একাত্মতা অনুভব করি। কিন্তু বস্তুত এই জাতীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের স্বরূপের কোন সম্পর্কই নেই; স্বরূপত আমরা যা তাই আছি। যখন আমরা এই সত্য জানতে পারি, যখন আমাদের স্বরূপ-জ্ঞান হয় তখন আমরা ঠিক ঠিক শক্তিমান হয়ে উঠি। যখন আমরা উপলব্ধি করি ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরমাত্মার কোন সম্পর্কই নেই, আমরা সাক্ষী-মাত্র, চারপাশের ঘটনাবলী দেখে যাচ্ছি—তখনই আমরা নিজেদের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে এক এবং অভিন্ন, এটি জানার নামই আত্মজ্ঞান। পরমাত্মার জন্ম নেই এবং সেই কারণে তাঁর মৃত্যুও নেই। তিনি অমর। তাই যখন আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করি, তখন আমরাও অমর হয়ে যাই (অমৃতম্)।