যেভাবে জগতের আর পাঁচটা বস্তুকে জানা যায়, ব্রহ্মকে সেইভাবে জানা যায় না। এর কারণ ব্ৰহ্ম কোন জ্ঞেয় বস্তু নন। সাধারণভাবে কোন বস্তুকে জানতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন : ‘জ্ঞেয়’ অর্থাৎ যে বস্তুটিকে জানতে চাই; ‘জ্ঞাতা’ অর্থাৎ যিনি জানবেন এবং ‘জ্ঞান’ অর্থাৎ যা জানা হল। কিন্তু যেহেতু তিনটি নিয়েই ব্রহ্ম, সেইহেতু ব্রহ্মকে জানার প্রশ্নই ওঠে না। আগুন অন্য বস্তুকে পোড়াতে পারে, কিন্তু নিজেকে কি পোড়াতে পারে? ব্রহ্মও ঐরকম।
যদি মন্যসে সুবেদেতি দভ্রমেবাপি
নূনং ত্বং বেত্থ ব্ৰহ্মণো রূপম্।
যদস্য ত্বং যদস্য দেবেষ্বথ নু
মীমাংস্যমেব তে মন্যে বিদিতম্॥১
অন্বয়: যদি (যদি); মন্যসে (তুমি মনে করো); সুবেদেতি [সুবেদ ইতি] (আমি ভালভাবে জানি [অর্থাৎ, আমি ব্ৰহ্মকে সম্যক্ রূপে জানি]); দভ্রম্ (অল্প [পাঠান্তরে ‘দহরম্’। ‘দভ্রম্’ ও ‘দহরম্’-এর একই অর্থ]); এব অপি নূনম্ (নিশ্চিতভাবে); ত্বং বেত্থ (তুমি জানো); ব্রহ্মণঃ রূপম্ (ব্রহ্মের স্বরূপ); যদস্য [যৎ অস্য] (ব্রহ্মের); ত্বং (তুমি [জানো]); যদস্য [যৎ অস্য] (ব্রহ্মের); দেবেষু (দেবতাদের মধ্যে বর্তমান); অথ নু (অতএব); তে (তোমার কাছে); মীমাংস্যম্ এব (গভীরভাবে বিচার্য); মন্যে (আমার মনে হয় [অর্থাৎ শিষ্য মনে করেন]); বিদিতম্ (এঁকে [ব্রহ্মকে] জেনেছি)।
সরলার্থ: যদি কেউ মনে করেন যে, আমি ব্রহ্মকে ভালমতো জেনে ফেলেছি, তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি জীবাত্মা, দেবতাদের ও দৃশ্যমান জগতে ব্রহ্মের প্রকাশকেই কেবল জেনেছেন। সুতরাং ব্রহ্ম সম্বন্ধে আরও গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন। (শিষ্য): আমার মনে হয়, আমি (ব্রহ্মকে) জানি।
ব্যাখ্যা: আচার্য শিষ্যকে এক সম্ভাব্য ভ্রান্তি সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। নিজের মধ্যে (জীবাত্মায়), দেবতাদের ও দৃশ্য জগতের মধ্যে ব্রহ্মের প্রকাশ দেখে শিষ্য হয়তো মনে করতে পারেন যে, ব্রহ্ম সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আছে। কিন্তু নিজের মধ্যে ও অন্যত্র যা প্রকাশিত, ব্রহ্ম তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। সব বস্তুর সারাৎসার, সকলের অন্তরাত্মা রূপে ব্রহ্ম অনন্ত, অসীম। তাই তাঁকে বোঝার সব চেষ্টাই শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। শিষ্যের প্রতি আচার্যের এই সাবধান-বাণীর প্রয়োজনীয়তা আছে, কারণ শিষ্য মনে করতে পারেন—ব্রহ্মকে আর পাঁচটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাধাবণ জিনিসের মতো দেখা যায়, ছোঁয়া যায়। এইজন্যেই গুরু শিষ্যকে ব্রহ্ম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে বলেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও শিষ্য বলছেন যে, তিনি জানেন। শুধু ‘জানি’ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন যে, নিজেকে পরীক্ষা করে তিনি নিঃসংশয় হয়েছেন স্বরূপত তিনি ব্রহ্মই। শিষ্যের এই গভীর আত্মপ্রত্যয় বলে দিচ্ছে তিনি ব্রহ্মকে জানেন। উপলব্ধিজাত এই প্রত্যয় এতই জোরালো যে কোন তর্কবিতর্ক শিষ্যকে টলাতে পারবে না।