শ্রোত্রস্য শ্ৰোত্ৰং মনসো মনো যদ্
বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।
চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ
প্ৰেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥২
অন্বয়: শ্রোত্রস্য শ্রোত্রম্ (কানেরও কান [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি শ্রবণেন্দ্রিয়কে চালনা করে]); মনসঃ মনঃ (মনেরও মন [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তির দ্বারা মন কাজ করে]); যদ্ বাচো হ বাচম্ (যা বাগিন্দ্রিয়ের বাক্ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি বাগিন্দ্রিয়কে পরিচালনা করে]); সঃ উ প্রাণস্য প্রাণঃ (তিনি প্রাণবায়ুরও প্রাণ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি প্রাণবায়ুকে চালনা করে]); চক্ষুষঃ চক্ষুঃ (চোখেরও চোখ [অর্থাৎ, প্রকৃত যে শক্তি চোখকে চালনা করে]); ধীরাঃ (প্রজ্ঞাবান বা বিচারশীল ব্যক্তিরা); অতিমুচ্য (ত্যাগ করে [অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়সমূহে আত্মবুদ্ধি ত্যাগ করে]); প্ৰেত্য (নিবৃত্ত হয়ে); অস্মাৎ লোকাৎ (এই জগৎ থেকে); অমৃতাঃ ভবন্তি (অমরত্ব লাভ করেন)।
সরলার্থ: (আচার্য)—এই (ব্রহ্মই) কানের প্রকৃত কান, মনের যথার্থ মন, কথার প্রকৃত শক্তি, শ্বাসের প্রকৃত শ্বাস, চোখের প্রকৃত চোখ। তাই জ্ঞানীরা দেহে আত্মবুদ্ধি না করে এই জগৎকে ত্যাগ করেন এবং অমর হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: আত্মার শক্তিতেই ইন্দ্রিয়গুলি শক্তিমান। মৃত্যুর সময় আত্মা তাঁর সেই শক্তি প্রত্যাহার করে নেন, তাই অক্ষত থাকলেও ইন্দ্রিয়গুলি অকেজো হয়ে পড়ে। ‘প্রেত্য’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘মৃত্যুর পর’। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে কথাটির অর্থ ‘নিবৃত্ত হয়ে’ বা ‘ত্যাগ করে’। কি ত্যাগ করতে হবে? দৃশ্যমান এই জড়জগৎ, নামরূপের এই প্রাতিভাসিক জগৎ। কেন? কারণ কেবলমাত্র প্রাতিভাসিক জগৎকে ত্যাগ করেই সেই পরম তত্ত্ব বা ব্রহ্মকে লাভ করা যায়। ঈশ উপনিষদও আমাদের সেই নির্দেশ দিচ্ছেন—‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা’ অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে পুষ্ট করো (ঈশ. উ. ১)। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে অন্তর্নিহিত যে ব্রহ্মসত্তা তাঁকে কেবলমাত্র ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং অমর হতে পারি। ‘প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি’—এই বাক্যের দ্বারা কেন উপনিষদ আমাদের সেই কথাই বলতে চাইছেন। চারপাশে যা ঘটছে তা দেখে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ আমাদের কাছে অত্যন্ত সত্য বলে মনে হয় এবং এই জগৎও নিঃসন্দেহে খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু আমরা যেন বিচারবুদ্ধি না হারাই; সত্যের প্রতি যেন আমাদের দৃষ্টি থাকে।
‘কেনেষিতম্’, কার নির্দেশে এই জগৎ সত্য বলে প্রতিভাত হয়? জগতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন যে ব্রহ্ম, তাঁরই নির্দেশে। ব্রহ্ম জগতের অধিষ্ঠান হয়ে আছেন বলেই এই জগৎকে সত্য মনে হয়। মাটিতে দড়ি পড়ে আছে বলেই সেটিকে সাপ বলে মনে হয়। সাপটা একটা চাপানো জিনিস। দড়িটি থাকাতেই সাপের অধ্যাস সম্ভব। দড়িটি সরিয়ে নিলে আর সাপ দেখা যাবে না। ঠিক সেইরকম, ব্রহ্মকে বাদ দিলে জগতের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না।