যস্তু সর্বাণি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে॥৬
যস্মিন্সৰ্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ॥৭
অন্বয়: যঃ তু (কিন্তু যিনি অর্থাৎ যে ব্যক্তি); আত্মনি এব (তাঁর মধ্যে); সর্বাণি (সকল); ভূতানি (ভূত সমূহ); অনুপশ্যতি (দেখেন); চ (এবং); সর্বভূতেষু (সর্বভূতে); আত্মানম্ (আত্মাকে); [অনুপশ্যতি (দেখেন)]; ততঃ (সেহেতু); ন বিজুগুপ্সতে (ঘৃণা করেন না)। যস্মিন্ (যখন); আত্মা এব (একমাত্র আত্মা); সর্বাণি (সকল); ভূতানি (ভূত সমূহ); অভূৎ (হয়েছে); তত্র (তখন); বিজানতঃ (যিনি এটা জানেন); একত্বম্ (একরূপে); অনুপশ্যতঃ (দেখেন যিনি); কঃ (কোথায়); মোহঃ (মোহ); কঃ (কোথায়); শোকঃ (শোক)।
সরলার্থ: যিনি নিজের মধ্যে সকলকে দেখেন এবং সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন, তিনি কোন কিছু ঘৃণা করেন না।
যখন কোন ব্যক্তি সব কিছুর মধ্যে এক আত্মাকেই দেখেন এবং জানেন যে তিনি নিজেই সব কিছু হয়েছেন, তখন তিনি কোন কিছুকে ঘৃণাও করেন না বা কোন কিছুর প্রতি আসক্তও হন না।
ব্যাখ্যা (Verse 6): একেই সমদর্শিতা বা সমদৃষ্টি বলা হয়ে থাকে। সকলের মধ্যে এক আত্মা বিরাজ করছেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলে এক, পার্থক্য শুধু নাম এবং রূপে। নাম এবং রূপ আত্মার ওপর আরোপিত মাত্র। নামরূপ সত্য নয়, অতএব এরা আত্মার অংশ নয়। নাম এবং রূপ যেন একটি স্বচ্ছ পর্দা যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রকৃত সত্তাকে দেখি। ছোট ছেলেরা নানা রকমের মুখোশ পরে তাদের বন্ধুদের ভোলায়। প্রথমে হয়তো সে বাঘের মুখোশ পরে বাঘের মতো ব্যবহার করে, ফলে তার বন্ধুরা ভয় পায়। পরমুহূর্তেই সে বাঁদরের মুখোশ পরে, বাঁদরের মতো লাফ দেয়। এতে আবার বন্ধুরা মজা পায়। এভাবে কিছুক্ষণ খেলা চলে। শেষপর্যন্ত সে যখন সব মুখোশ সরিয়ে দেয়, তখন তার আসল চেহারা প্রকাশ পায়। ছেলেরা তখন বোঝে মুখোশ পরা ছেলেটি তাদেরই বন্ধু। আসলে তো সে বরাবরই এক, মুখোশের জন্য তাকে নানারকম মনে হচ্ছিল। ঠিক সেইরকম আমরাও সকলে এক ও অভিন্ন। শুধুমাত্র নামরূপের বিভিন্নতার জন্য আমাদের পৃথক দেখায়।
এই শ্লোকে আমরা যে স্বরূপত এক, একথাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সর্বত্র সেই একই সত্তা বিরাজিত। কিছু খণ্ডিত অংশকে একত্রিত করে এই ঐক্যের সৃষ্টি হয়নি। কারণ আত্মা সকলের মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান। আমি যদি কাউকে আঘাত করি, তা হলে এমন হবে, তার দ্বারা যেন আমি আমাকেই আঘাত করেছি। সকলে সুখী হলেই আমরা সুখী। মানুষ, পশু, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ আমরা সবাই এক। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে এই একত্বকে উপলব্ধি করা। এই একের উপলব্ধি হলে মনে আর কোন বিদ্বেষ বা গোপনতার স্থান থাকে না। তখন থাকে শুধু সকলের প্রতি প্রেম।
ব্যাখ্যা (Verse 7): সবকিছুর সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করার মধ্য দিয়েই আত্মজ্ঞানের যথার্থ পরীক্ষা হয়। আমি সর্বত্র এবং সর্বভূতে রয়েছি। সেখানে ‘এক’ ভিন্ন ‘দুই’ নেই। সেই ‘এক’ই হল স্বয়ং ‘আমি’। এই একত্বকে উপলব্ধি করাই হল জীবনের পরম লক্ষ্য। ব্যবহারিক জীবনে যে বৈচিত্র আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু নামরূপের বিভিন্নতার জন্যই এই বৈচিত্র। আর এই নামরূপ আমাদের মনেরই কল্পনা মাত্র। এতে আমার কোন পরিবর্তন হয় না। আমি সেই অপরিবর্তিত এক সত্তামাত্র।
যখন আমরা এই একত্বকে উপলব্ধি করতে পারব, তখন আমাদের আসক্তি, ঘৃণা, বা দুঃখ বলে কিছু থাকবে না। দ্বৈত বোধ আসে অজ্ঞানতা থেকে। আত্মজ্ঞান লাভে অর্থাৎ অদ্বৈতের উপলব্ধিতে এই অজ্ঞানতা সমূলে বিনষ্ট হয়।