Chapter 2
- সঞ্জয় বললেন-ঐ প্রকার করুণার্দ্র এবং অশ্রুপূর্ণ আকুললোচন বিষণ্ণ অর্জুনকে তখন ভগবান এই কথা বললেন। (2.1)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে অর্জুন! এই অসময়ে তোমার মধ্যে এরূপ মোহ কোথা হতে এলো? শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা এইরকম আচরণ করেন না এবং এই মোহ স্বর্গ বা কীর্তি কোনোটিই প্রদান করে না। (2.2)
- সুতরাং হে অর্জুন! ক্লীবভাব আশ্রয় করো না, তোমার এটা শোভা পায় না। হে পরন্তপ! হৃদয়ের এই তুচ্ছ দুর্বলতা পরিত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য উত্থিত হও। (2.3)
- অর্জুন উবাচ
- তাঁকেই অবিনাশী বলে জানবে যাঁর দ্বারা এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই অবিনাশীর বিনাশ করতে কেউই সক্ষম নয়। (2.17)
- অবিনশ্বর, অপ্রমেয়, নিত্যস্বরূপ জীবাত্মার এই সকল শরীরকে বিনাশশীল বলা হয়েছে। তাই হে ভরতবংশীয় অর্জুন! তুমি যুদ্ধ করো। (2.18)
- যিনি এই আত্মাকে হত্যাকারী মনে করেন অথবা যিনি এঁকে নিহত বলে মনে করেন তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না; কারণ এই আত্মা প্রকৃতপক্ষে কাউকে হত্যা করেন না এবং কারো দ্বারা হতও হন না। (2.19)
- এই আত্মা কখনও জন্মান না বা মরেনও না এবং আত্মার অস্তিত্ব উৎপত্তিসাপেক্ষ নয়, কারণ আত্মা জন্মরহিত, নিত্য, সনাতন এবং পুরাতন; শরীর বিনষ্ট হলেও আত্মা বিনষ্ট হন না। (2.20)
- হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, জন্মরহিত এবং অব্যয় বলে জানেন, তিনি কীভাবে কাকেও হত্যা করবেন বা করাবেন? (2.21)
- যেমন মানুষ পুরানো বস্ত্র পরিত্যাগ করে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমনই জীবাত্মা পুরণো শরীরগুলিকে ত্যাগ করে অন্য নূতন নূতন শরীর গ্রহণ করে। (2.22)
- শস্ত্র এই আত্মাকে কাটতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না, জল সিক্ত করতে পারে না এবং বায়ু এঁকে শুষ্ক করতে পারে না। (2.23)
- কারণ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষ্য এবং নিত্য, সর্বব্যাপী, অচল, স্থির ও সনাতন। (2.24)
- এই আত্মাকে অব্যক্ত, অচিন্ত্য এবং বিকাররহিত বলা হয়। তাই হে অর্জুন ! এই আত্মাকে উক্তপ্রকার জেনে তোমার শোক করা উচিত নয়। (2.25)
- আর যদি তুমি এই আত্মাকে নিত্য জন্মশীল এবং নিত্য মরণশীল বলে মনে করো, তবুও হে মহাবাহো ! তোমার শোক করা উচিত নয়। (2.26)
- কারণ এইরূপ মনে করলেও যে জন্মায় তার মৃত্যু নিশ্চিত এবং মৃতের জন্মও নিশ্চিত। সুতরাং এই অপরিহার্য বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়। (2.27)
- হে ভারত ! সমস্ত প্রাণী জন্মের পূর্বে অপ্রকট ছিল, মৃত্যুর পরও অপ্রকট হয়ে যায়, কেবল মধ্যবর্তী সময়েই প্রকটিত থাকে। এই পরিস্থিতিতে বিলাপ কিসের ? (2.28)
- …………
- কিন্তু যদি তুমি এই ধর্মযুদ্ধ না করো তা হলে স্বধর্ম ও কীর্তি হতে চ্যুত হয়ে পাপভাগী হবে। (2.33)
- এবং সকলেই তোমার এই দীর্ঘকালস্থায়ী অকীর্তি (অখ্যাতি) নিয়ে আলোচনা করবে। মাননীয় ব্যক্তির পক্ষে এই অকীর্তি মৃত্যু অপেক্ষাও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। (2.34)
- আর যাঁদের দৃষ্টিতে তুমি খুবই সম্মানিত ছিলে তাঁদের চোখে হেয় হয়ে যাবে। এই মহারথিগণ মনে করবেন তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হয়েছ। (2.35)
- তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে অনেক অকথ্য কথাও বলবে, এর থেকে বেশি দুঃখজনক আর কী হতে পারে ? (2.36)
- যদি তুমি যুদ্ধে নিহত হও, তা হলে স্বর্গ লাভ করবে আর যদি জয়লাভ করো তাহলে পৃথিবীর রাজত্ব ভোগ করবে। তাই হে অর্জুন ! তুমি যুদ্ধের জন্য দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে উত্থিত হও। (2.37)
- জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখকে সমান মনে করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও ; এইভাবে যুদ্ধ করলে তুমি পাপগ্রস্থ হবে না। (2.38)
- হে পার্থ ! তোমার জন্য এই তত্ত্ব (সমত্ব বুদ্ধি) জ্ঞানযোগের বিষয়ে বলা হল, এখন তুমি কর্মযোগের কথা শোন—এই বুদ্ধি দ্বারা যুক্ত হলে তুমি অনায়াসে কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হবে। (2.39)
- নিষ্কাম কর্মযোগে আরম্ভের বিফলতা হয় না এবং বিপরীত ফলরূপ দোষও হয় না, উপরন্তু এই নিষ্কাম কর্মযোগরূপ ধর্মের স্বল্প অনুষ্ঠানও জন্ম-মৃত্যুরূপ মহাভয় হতে রক্ষা করে। (2.40)
- হে কুরুনন্দন ! এই নিষ্কাম কর্মযোগে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ হয়। কিন্তু অস্থির চিত্ত সকাম ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট ও বহুমুখী হয়ে থাকে। (2.41)
- হে পার্থ! অবিবেকিগণ যারা পুষ্পিত অর্থাৎ আপাত-মনোহর বাক্য বলে, স্বর্গ হতে যাদের কাছে বড় আর কিছুই নেই,কর্মফল- প্রশংসাকারী বেদবাক্যেই যাদের চিত্ত আকৃষ্ট…(2.42)
- …যাদের বুদ্ধিতে স্বর্গই পরমপ্রাপ্য বস্তু, যাদের বাণীও জন্মরূপ কর্মফল প্রদান করে এবং ভোগ তথা ঐশ্বর্য প্রাপ্তির জন্য যারা নানা ক্রিয়ার বর্ণনা করে, …(2.43)
- যারা ভোগে আসক্তচিত্ত, সেইসকল বাক্য দ্বারা যাদের চিত্ত অপহৃত হয়ে ভোগ ও ঐশ্বর্যর প্রতি আসক্ত হয়, তাদের পরমাত্মাতে নিশ্চয়াত্মিকা শুদ্ধ বুদ্ধি হতে পারে না। (2.44)
- হে অর্জুন! বেদ পূর্বোক্ত ভাবে ত্রিগুণের কার্যরূপ সমস্ত ভোগ এবং তারই সাধনের প্রতিপাদক; সুতরাং তুমি ঐসব ভোগ এবং তার সাধনে আসক্তি বর্জিত হও, হর্ষ-শোকাদি দ্বন্দ্বরহিত ও নিত্যবস্তুতে (পরমাত্মাতে) স্থিত হও এবং যোগ-ক্ষেমের আকাঙ্ক্ষাহীন তথা আত্মপরায়ণ হও। (2.45)
- সর্বত্র পরিপূর্ণ জলাশয় প্রাপ্ত হলে ক্ষুদ্র জলাশয়ে মানুষের যেটুকু প্রয়োজন, ব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণের বেদে ততটাই প্রয়োজন । (2.46)
- কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। অতএব তুমি কর্ম-ফলের হেতু হয়ো না আবার কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়। (2.47)
- হে ধনঞ্জয় ! তুমি আসক্তি ত্যাগ করে এবং সিদ্ধি অসিদ্ধিতে সমভাবাপন্ন থেকে যোগস্থ হয়ে সকল কর্ম করো। এই সমত্ব-কেই যোগ বলা হয়। (2.48)
- এই সমত্বরূপ বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা সকাম-কর্ম নিতান্তই নিকৃষ্ট। তাই, হে ধনঞ্জয় ! তুমি সমত্ববুদ্ধি যোগের আশ্রয় নাও, কারণ যারা ফলের হেতু হয় অর্থাৎ ফলাকাঙ্ক্ষাবশতঃ কর্ম করে, তারা অত্যন্ত দীন। (2.49)
- সমত্ববুদ্ধিযুক্ত পুরুষ ইহলোকেই পাপ এবং পুণ্য দুই-ই পরিত্যাগ করেন অর্থাৎ এগুলি হতে মুক্তিলাভ করেন। তাই তুমি সমত্বরূপ যোগের আশ্রয় নাও ; এই সমত্বরূপ যোগই হল কর্মের কৌশল অর্থাৎ কর্ম বন্ধন হতে মুক্ত হবার উপায়। (2.50)
- কারণ সমবুদ্ধিসম্পন্ন জ্ঞানীগণ কর্মজনিত ফল ত্যাগ করে জন্মরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে নির্বিকার পরমপদ লাভ করেন। (2.51)
- যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ কর্দম সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি শ্রুত এবং শ্রোতব্য ইহলোক এবং পরলোক সম্পর্কীয় সমস্ত বিষয় ভোগে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হবে। (2.52)
- নানা কথার দ্বারা বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন পরমাত্মায় অটল ও স্থির হবে , তখন তুমি যোগপ্রাপ্ত হবে অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে তোমার নিত্য সংযোগ স্থাপিত হবে। (2.53)
- অর্জুন বললেন, হে কেশব ! সমাধিতে স্থিত পরমাত্মাকে প্রাপ্ত স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তির লক্ষণ কী ? স্থিতধী ব্যক্তি কীভাবে কথা বলেন ? কীরূপে অবস্থান করেন ? কীভাবে চলেন ? (2.54)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-হে অর্জুন ! যখন এই ব্যক্তি মন থেকে সমস্ত কামনা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেন এবং আত্মা দ্বারা আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তাঁকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। (2.55)
- দুঃখে অনুদ্বিগ্ন চিত্ত, সুখে স্পৃহাহীন এবং আসক্তি, ভয় এবং ক্রোধ রহিত মুনিকেই স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। (2.56)
- যিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিতে আসক্তিরহিত এবং শুভ ও অশুভ বস্তুর প্রাপ্তিতে প্রসন্ন হন না বা দ্বেষ করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। (2.57)
- কচ্ছপ যেমন আপন অঙ্গসমূহ সংহরণ করে নেয়, সেইরূপ যিনি ইন্দ্রিয়াদির বিষয় হতে ইন্দ্রিয়দের সর্বপ্রকারে সংহরণ করেন, তাঁকেই স্থিতপ্রজ্ঞ বলে জানবে। (2.58)
- ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা বিষয় উপভোগে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়ভোগ নিবৃত্ত হলেও ইন্দ্রিয়াদির বিষয়াসক্তি নিবৃত্ত হয় না। কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির আসক্তি পরমাত্মার সাক্ষাৎ লাভে সর্বতোভাবে দূর হয়। (2.59)
- হে অর্জুন! আসক্তি সর্বতোভাবে দূর না হলে চিত্ত আলোড়নকারী ইন্দ্রিয়সকল যত্নশীল বুদ্ধিমান ব্যক্তির মনকেও বলপূর্বক হরণ করে। (2.60)
- অতএব যোগী ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে সমাহিত চিত্তে মৎপরায়ণ হয়ে অবস্থান করবেন, কারণ যাঁর ইন্দ্রিয় বশীভূত, তাঁরই বুদ্ধি স্থির হয়। (2.61)
- বিষয়চিস্তা করতে করতে মানুষের ঐ বিষয়ে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি হতে কামনা উৎপন্ন হয় এবং কামনায় বাধা পড়লে ক্রোধের জন্ম হয়। (2.62)
- ক্রোধ হতে মুঢ়ভাব উৎপন্ন হয়, মূঢ়ভাব হতে স্মৃতিভ্রংশ হয়, স্মৃতিভ্রংশে বুদ্ধি নাশ হয় এবং বুদ্ধি নাশ হলে পতন হয়। (2.63)
- কিন্তু যিনি অন্তঃকরণকে বশীভূত করেছেন, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষবর্জিত বশীভূত ইন্দ্রিয়াদি সহযোগে বিষয়সমূহে বিচরণ করেও অন্তঃকরণের প্রসন্নতা লাভ করেন। (2.64)
- অন্তঃকরণের প্রসন্নতার ফলে তাঁর সমস্ত দুঃখ নাশ হয় এবং সেই প্রসন্নচিত্ত কর্মযোগীর বুদ্ধি অচিরে সর্বদিক হতে নিবৃত্ত হয়ে পরমাত্মাতে স্থির হয়। (2.65)
- যার মন এবং ইন্দ্রিয় নিজের বশে নেই, তার নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি হয় না এবং সেই অযুক্ত ব্যক্তির অন্তঃকরণে ভগবৎ চিন্তা জাগে না। আত্মচিন্তা বর্জিত মানুষের শান্তি অসম্ভব আর শান্তিরহিত মানুষের সুখ কোথায় ? (2.66)
- কারণ জলের মধ্যে বিচরণশীল নৌকাকে যেমন বায়ু বিচলিত করে, তেমনি বিষয়ভোগে বিচরণকারী ইন্দ্রিয় সমূহের মধ্যে মন যেটিতে আকৃষ্ট হয় সেই ইন্দ্রিয়টিই অযুক্ত পুরুষের বুদ্ধি হরণ করে। (2.67)
- সেইজন্য হে মহাবাহো ! যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়াদির বিষয় হতে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তাঁরই প্রজ্ঞা স্থির হয়েছে বলে জানবে। (2.68)
- সমস্ত প্রাণীর পক্ষে যা রাত্রির সমান, নিত্য জ্ঞানস্বরূপ পরমানন্দে স্থিতপ্রজ্ঞ যোগী তাতে জাগ্রত থাকেন এবং বিনাশশীল জাগতিক সুখ প্রাপ্তির আশায় সমস্ত প্রাণী যাতে জাগরিত থাকে, পরমাত্ম-তত্ত্বজ্ঞানী মুনির কাছে তা রাত্রির সমান। (2.69)
- যেমন বিভিন্ন নদীর জল পরিপূর্ণ অচল, স্থির সমুদ্রে এসে তাকে বিচলিত না করেই বিলীন হয়ে যায় তেমনই সমস্ত বিষয়ভোগও যাঁর মধ্যে কোনো বিকার উৎপন্ন না করে বিলীন হয়, তিনিই পরমশান্তি লাভ করেন, কিন্তু যিনি ভোগ্যপদার্থ কামনা করেন, তাঁর পক্ষে শান্তিলাভ অসম্ভব। (2.70)
- যিনি সমস্ত কামনা পরিত্যাগ করে মমত্বশূন্য ও অহং বর্জিত এবং নিস্পৃহ হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই পরম শান্তি লাভ করেন অর্থাৎ তাঁর ঈশ্বর লাভ হয়েছে। (2.71)
- হে অর্জুন! এ হল ব্রহ্মপ্রাপ্ত পুরুষের স্থিতি, এই স্থিতি লাভের পর তিনি আর কখনও মোহগ্রস্ত হন না। অন্তিম সময়েও যিনি এই ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করেন তিনি ব্রহ্মানন্দ লাভ করেন। (2.72)
Chapter 4
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—এই অবিনাশী যোগ আমি সূর্যকে বলেছিলাম ; সূর্য তাঁর পুত্র বৈবস্বত মনুকে, মনু তাঁর পুত্র রাজা ইক্ষ্বাকুকে এটি বলেছিলেন। (4.1)
- হে পরন্তপ অর্জুন ! এইভাবে পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ জেনেছিলেন। কিন্তু তার পরে এই যোগ দীর্ঘকালের ব্যবধানে পৃথিবী লোক হতে প্রায় বিনষ্ট হয়েছে। (4.2)
- তুমি আমার ভক্ত ও প্রিয় সখা, সেইজন্য এই পুরাতন যোগ আজ আমি তোমাকে বললাম ; কারণ এটি অতি উত্তম রহস্য অর্থাৎ গোপনীয় বিষয়। (4.3)
- অর্জুন বললেন-আপনার জন্ম তো এখন অর্থাৎ এই যুগে হয়েছে আর সূর্যের জন্ম তো বহু পূর্বে অর্থাৎ কল্পের আদিতে হয়েছে। তবে আমি কী করে বুঝব যে আপনিই কল্পের আদিতে এই যোগের কথা সূর্যকে বলেছিলেন ? (4.4)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন –হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে; সে সব তুমি জানো না, কিন্তু আমি জানি। (4.5)
- আমি জন্মরহিত, অবিনাশীস্বরূপ এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও নিজ প্রকৃতিকে অধীন করে স্বীয় যোগমায়া দ্বারা প্রকটিত হই। (4.6)
- হে ভারত ! যখনই ধর্মের হানি এবং অধর্মের বৃদ্ধি হয়, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি অর্থাৎ সাকাররূপে জনসমক্ষে প্রকট হই। (4.7)
- সাধুদের রক্ষার জন্য, পাপীদের বিনাশের জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। (4.8)
- হে অর্জুন! আমার জন্ম ও কর্ম দিব্য অর্থাৎ নির্মল ও অলৌকিক—এইভাবে যে ব্যক্তি আমাকে তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না অর্থাৎ তিনি আমাকেই লাভ করেন। (4.9)
- যাঁদের আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ সর্বতোভাবে নষ্ট হয়েছে, যাঁরা আমার প্রেমে একাগ্রচিত্ত এবং আমার শরণাপন্ন—এরূপ বহু ভক্ত জ্ঞানরূপ তপস্যা দ্বারা পবিত্র হয়ে আমার স্বরূপে স্থিতি লাভ করেছেন। (4.10)
- হে অর্জুন ! যে ভক্ত আমাকে যেভাবে ভজনা করেন, আমিও তাঁকে সেইভাবেই ভজনা করি ; কারণ সকল মানুষই সর্বতোভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করেন । (4.11)
- এই মনুষ্যলোকে কর্মফলাকাঙ্ক্ষাযুক্ত মানুষ দেবতাগণের পূজা করেন, কারণ কর্মজনিত সিদ্ধি তাঁরা লাভ করেন। (4.12)
- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র—এই বর্ণচতুষ্টয় গুণ এবং কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করেছি। সৃষ্টি-কর্মের কর্তা হলেও অবিনাশী, পরমেশ্বররূপ আমাকে তুমি প্রকৃতপক্ষে অকর্তা বলেই জানবে। (4.13)
- কর্মফলে আমার স্পৃহা নেই, তাই কোনো কর্ম আমাকে আবদ্ধ করতে পারে না—এইরূপে যিনি আমাকে তত্ত্বতঃ জানেন, তিনিও কর্মের দ্বারা আবদ্ধ হন না। (4.14)
- এইরূপ জেনেই পূর্বতন মুমুক্ষুগণও (মুমুক্ষু – যিনি মোক্ষাকাঙ্ক্ষী) নিষ্কাম কর্ম করেছেন। এইজন্য তুমিও পূর্বসূরিগণের দ্বারা নিত্য আচরিত কর্মই পালন করো। (4.15)
- কর্ম কী, অকর্ম কী ?-এর যথার্থ নির্ণয় করতে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও বিভ্রান্ত হন। সেইজন্য এই কর্মতত্ত্ব আমি তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলছি যাতে তুমি অশুভ হতে অর্থাৎ কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হতে পারো। (4.16)
- কর্ম, অকর্ম ও বিকর্মের স্বরূপ (তত্ত্ব) জানা উচিত, কারণ কর্মের গতি অত্যন্ত দুর্জ্ঞেয়। (4.17)
- যে ব্যক্তি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখেন, মানুষের মধ্যে তিনিই জ্ঞানী ও যোগযুক্ত এবং সর্বকর্মকারী। (4.18)
- যাঁর সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা, কামনা ও সংঙ্কল্পরহিত এবং যাঁর সমস্ত কর্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়েছে, জ্ঞানিগণও তাঁকে পণ্ডিত বলে থাকেন। (4.19)
- যিনি সকল কর্ম ও তার ফলে আসক্তি সর্বতোভাবে বৰ্জনপূর্বক সংসারের আশ্রয় ত্যাগ করেছেন এবং পরমাত্মাতে নিত্য তৃপ্তি লাভ করেছেন, তিনি কর্মসমূহে বিশেষভাবে প্রবৃত্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কিছুই করেন না। (4.20)
- যাঁর অন্তঃকরণ এবং ইন্দ্রিয়াদিসহ শরীর স্ববশে আছে এবং যিনি সকল প্রকার ভোগ্যসামগ্রী ত্যাগ করেছেন, সেইরূপ আশারহিত ব্যক্তি শুধুমাত্র শরীর ধারণের উপযোগী কর্ম করলেও কোনোরূপ পাপের ভাগী হন না। (4.21)
- যিনি কোনো ইচ্ছা না রেখে যা পান তাতেই তুষ্ট, ঈর্ষাশূন্য, হর্ষ-শোকাদি দ্বন্দ্ব হতে মুক্ত এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমজ্ঞানসম্পন্ন,—তিনি শরীর ধারণের উপযোগী কর্ম করলেও তাতে আবদ্ধ হন না। (4.22)
- যিনি সর্বতোভাবে আসক্তি বর্জন করেছেন, দেহাভিমান (অহংবোধ) ও মমত্বরহিত হয়েছে এবং যাঁর চিত্ত নিরন্তর পরমাত্মতত্ত্বে স্থিত, কেবলমাত্র যজ্ঞ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে যিনি কর্ম করেন তাঁর সমস্ত কর্ম বিলীন হয়ে যায় অর্থাৎ তা ফল প্রসব করে না। (4.23)
- যে যজ্ঞে অর্পণ অর্থাৎ স্রুবাদিও (যার দ্বারা হবি অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত হয়) ব্রহ্ম এবং আহুত দ্রব্যাদিও ব্রহ্ম তথা ব্রহ্মরূপ যজ্ঞকর্তার দ্বারা ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদানরূপ ক্রিয়াও ব্রহ্ম—সেই ব্রহ্মকর্মে নিবিষ্টচিত্ত যোগীর প্রাপ্ত ফলও হল ব্রহ্ম। (4.24)
- অন্যান্য যোগিগণ দেবপূজারূপ যজ্ঞের যথাযথ অনুষ্ঠান করেন এবং অন্য কোনো যোগী পরব্রহ্ম পরমাত্মারূপ অগ্নিতে অভেদদর্শনরূপ যজ্ঞের দ্বারা আত্মরূপ যজ্ঞের আহুতি প্রদান করেন। (4.25)
- অন্য যোগিগণ শ্রোত্রাদি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযমরূপ অগ্নিতে আহুতি দেন এবং অপর যোগিগণ শব্দাদি সমস্ত বিষয়কে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দেন। (4.26)
- অন্য যোগিগণ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কর্ম এবং প্রাণের সকল কর্ম জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশিত আত্মসংযমযোগরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদান করেন। (4.27)
- কেউ কেউ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেউ আবার তপস্যারূপ যজ্ঞ করেন, কেউ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, আবার অহিংসাদি দৃঢ়ব্রতধারী যত্নশীল অনেক ব্যক্তি স্বাধ্যায়রূপ জ্ঞানযজ্ঞ করেন। (4.28)
- আবার অন্যান্য যোগিগণ অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু আহুতি দেন, সেইরূপ কেউ আবার প্রাণবায়ুতে অপানবায়ুর আহুতি দেন। আবার কোনো নিয়মিত আহারী প্রাণায়ামপরায়ণ হয়ে প্রাণ ও অপানের গতিরুদ্ধ করে প্রাণকে প্রাণে আহুতি দেন। এই সকল সাধকই হলেন যজ্ঞের দ্বারা পাপসমূহের বিনাশকারী এবং যজ্ঞসমূহের জ্ঞাতা। (4.29 & 4.30)
- হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জুন! যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত অনুভবকারী যোগিগণ সনাতন পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে লাভ করেন। আর যাঁরা যজ্ঞ করেন না তাঁদের ইহলোকও সুখদায়ক হয় না, পরলোক তো দূরের কথা ! (4.31)
- এইরূপ আরও বহুপ্রকার যজ্ঞের কথা বেদে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এ সবই মন, ইন্দ্রিয়াদি ও কায়িক ক্রিয়ার দ্বারা সম্পন্ন হয় বলে জানবে, এইরূপ তত্ত্বতঃ জেনে এগুলির অনুষ্ঠান করলে তুমি কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হবে। (4.32)
- হে পরন্তপ অর্জুন ! দ্রব্যময় যজ্ঞ হতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, কারণ সমস্ত কর্ম জ্ঞানেই সমাপ্ত হয়। (4.33)
- সেই জ্ঞান তুমি তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে জেনে নাও ; তাঁদের বিনয়পূর্বক প্রণাম ও সেবা তথা কপটতা ত্যাগ করে সরলভাবে প্রশ্ন করলে সেই তত্ত্বদর্শী জ্ঞানিগণ তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে উপদেশ দেবেন। (4.34)
- যা জানলে তুমি আর এইরূপ মোহগ্রস্ত হবে না এবং হে অর্জুন ! যে জ্ঞানের দ্বারা তুমি সমস্ত ভূতাদি নিরবশেষ প্রথমে নিজের মধ্যে এবং পরে সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মারূপী আমাতে দেখতে সক্ষম হবে। (4.35)
- যদি তুমি সমস্ত পাপীর থেকেও অধিক পাপী হও তা হলেও তুমি জ্ঞানরূপ নৌকার সাহায্যে নিঃসন্দেহে সমগ্র পাপসাগর উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। (4.36)
- কারণ হে অর্জুন ! প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন ইন্ধনকে ভস্মীভূত করে, জ্ঞানরূপ অগ্নিও তেমনই সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে। (4.37)
- নিঃসন্দেহে এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্রকারী আর কিছুই নেই। দীর্ঘকাল প্রযত্ন দ্বারা কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হলে সাধক স্বয়ংই নিজের মধ্যে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। (4.38)
- জিতেন্দ্রিয়, সাধনপরায়ণ, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই ভগবৎ প্রাপ্তিরূপ পরমশান্তি লাভ করেন। (4.39)
- বিবেকরহিত ও শ্রদ্ধাহীন সংশয়াকুল ব্যক্তি পারমার্থিক পথ হতে অবশ্যই ভ্রষ্ট হয়। এইরূপ সংশয়াত্মার ইহলোকও নেই, পরলোকও নেই এবং সুখও নেই। (4.40)
- হে ধনঞ্জয় ! যিনি কর্মযোগের দ্বারা সমস্ত কর্ম পরমাত্মায় অর্পণ করেছেন এবং বিবেকের দ্বারা সমস্ত সংশয় নাশ করেছেন এইরকম বশীভূত-চিত্ত ব্যক্তিকে কর্ম কখনও বদ্ধ করতে পারে না। (4.41)
- অতএব হে ভরতবংশীয় অর্জুন ! তুমি হৃদয়স্থিত এই অজ্ঞানজাত সংশয়কে বিবেকজ্ঞানরূপ তরবারির সাহায্যে ছেদন করে সমত্বরূপ যোগে স্থিত হও এবং যুদ্ধের জন্য উত্থিত হও। (4.42)
Chapter 5
- অর্জুন বললেন—হে কৃষ্ণ ! আপনি কর্মসন্ন্যাস এবং কর্মযোগ—উভয়েরই প্রশংসা করছেন। অতএব এই দুটির মধ্যে যেটি আমার পক্ষে নিশ্চিতরূপে কল্যাণকর, সেটি বলুন। (5.1)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন-কর্মসন্ন্যাস এবং কর্মযোগ উভয়ই কল্যাণকর; কর্মসন্ন্যাসের তুলনায় কর্মযোগ সুগম হওয়ায় শ্রেষ্ঠ। (5.2)
- হে অর্জুন ! যিনি কারও প্রতি দ্বেষ করেন না এবং কোনও কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না, সেই নিষ্কাম কর্মযোগীকে নিত্য-সন্ন্যাসী বলে জানবে। কারণ রাগ (আসক্তি)-দ্বেষরূপ দ্বন্দ্ব-রহিত পুরুষ অনায়াসে সংসারবন্ধন হতে মুক্ত হন। (5.3)
- মূর্খ ব্যক্তিগণ উপরিউক্ত সন্ন্যাস ও কর্মযোগকে পৃথক ফল প্রদানকারী বলে থাকে, পণ্ডিতেরা তা বলেন না ; কারণ দুটির মধ্যে একটিতে সম্যকভাবে স্থিত পুরুষ উভয়েরই ফলস্বরূপ একই পরমাত্মতত্ত্ব প্রাপ্ত হন। (5.4)
- জ্ঞানযোগী যে পরমধাম লাভ করেন, কর্মযোগীও সেই ধাম প্রাপ্ত হন। তাই যিনি জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগকে ফলরূপে অভিন্ন দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী। (5.5)
- কিন্তু হে অর্জুন ! নিষ্কাম কর্মযোগ ব্যতিরেকে সন্ন্যাস অর্থাৎ মন, ইন্দ্রিয় এবং শরীরের দ্বারা করা সমস্ত কর্মে কর্তৃত্বভাব ত্যাগ করা কঠিন কিন্তু ভগবৎ স্বরূপ মননকারী নিষ্কাম কর্মযোগী পরব্রহ্ম পরমাত্মাকে শীঘ্রই লাভ করেন। (5.6)
- যাঁর মন বশীভূত, যিনি জিতেন্দ্রিয়, বিশুদ্ধচিত্ত সর্বপ্রাণীর আত্মারূপ পরমাত্মাই যাঁর আত্মস্বরূপ,এইরূপ নিষ্কাম কর্মযোগী কর্ম করলেও তাতে লিপ্ত হন না। (5.7)
- তত্ত্বদর্শী সাংখ্যযোগী দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিঃশ্বাসগ্রহণ, তত্ত্বদর্শী সাংখ্যযোগী দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিঃশ্বাসগ্রহণ,… (5.8)
- …কথোপকথন, মলমূত্রাদি ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ এবং নিমেষ ইত্যাদি কার্যে ‘ইন্দ্রিয়গণ স্ব স্ব বিষয়সমূহে প্রবর্তিত এইরূপ বুঝে নিঃসন্দেহে মনে করেন যে আমি কিছুই করি না। (5.9)
- যিনি সমস্ত কর্ম পরমাত্মায় অর্পণ করেন এবং আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করেন, তিনি জলে পদ্মপত্রের ন্যায় পাপে লিপ্ত হন না। (5.10)
- নিষ্কাম কর্মযোগী ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি এবং শরীরের প্রতি মমত্ববুদ্ধি রহিত হয়ে আসক্তি ত্যাগ করে চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কর্ম করেন। (5.11)
- নিষ্কাম কর্মযোগী কর্মফল ত্যাগ করে অবিচল শান্তি (ভগবৎ প্রাপ্তি) লাভ করেন আর সকাম ব্যক্তি কামনাবশতঃ ফলে আসক্ত হয়ে আবদ্ধ হন। (5.12)
- বশীভূত অন্তঃকরণযুক্ত সাংখ্যযোগের আচরণকারী পুরুষ, কর্ম না করে বা না করিয়ে নবদ্বারযুক্ত দেহে সমস্ত কর্ম মনে মনে ত্যাগ করে আনন্দে সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মার স্বরূপে স্থিত থাকেন। (5.13)
- কারণ পরমেশ্বর মানুষের কর্তৃত্বভাব, কর্ম বা কর্মফলের সংযোগ রচনা করেন না, কিন্তু স্বভাবই (প্রকৃতি) প্রবর্তিত হয় । (5.14)
- সর্বব্যাপী পরমাত্মা কারও পাপ বা পুণ্য গ্রহণ করেন না, কিন্তু অজ্ঞানের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকায় মানুষ মোহগ্রস্ত হয় । (5.15)
- কিন্তু আত্মজ্ঞান দ্বারা অন্তঃকরণের অজ্ঞান যাঁদের বিনষ্ট হয়েছে তাঁদের সেই জ্ঞান সূর্যের ন্যায় সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মাকে প্রকাশিত করে। (5.16)
- যাঁদের মন তাঁতে নিবিষ্ট, যাঁদের বুদ্ধিও তাঁতে স্থিত এবং যাঁরা সেই সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মায় নিরন্তর একীভাবে অবস্থান করেন, সেই তৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ জ্ঞানের দ্বারা পাপরহিত হয়ে অপুনরাবৃত্তি অর্থাৎ পরমগতি প্রাপ্ত হন। (5.17)
- ব্রহ্মনিগণ বিদ্যা ও বিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে, গো, হস্তী, কুকুর তথা চণ্ডালেও সমদর্শী হন। (5.18)
- যাঁদের মন সমভাবে স্থিত, তাঁরা জীবিত অবস্থাতেই সংসার জয় করেছেন; কারণ সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মা নির্দোষ এবং সম, তাই তাঁরা সেই পরমাত্মাতেই অবস্থান করেন। (5.19)
- যাঁরা প্রিয়বস্তু লাভে হৃষ্ট হন না এবং অপ্রিয়বস্তু প্রাপ্ত হলে উদ্বিগ্ন হন না ; স্থিরবুদ্ধি, সংশয়রহিত— এইরূপ ব্রহ্মবেত্তা পুরুষ সচ্চিদানন্দঘন পরব্রহ্ম পরমাত্মাতে নিত্যই স্থিত। (5.20)
- বাহ্য বিষয়ে অনাসক্ত পুরুষ আত্মায় যে শাশ্বত আনন্দ আছে তা লাভ করেন, অতঃপর সচ্চিদানন্দঘন পরব্রহ্ম পরমাত্মার ধ্যানরূপ যোগে অভিন্নভাবে স্থিত হয়ে তিনি অক্ষয় আনন্দ অনুভব করেন। (5.21)
- ভোগ যদিও বিষয়ীলোকের কাছে সুখরূপে ভাসিত হয়, কিন্তু আসলে তা দুঃখেরই হেতু। এর আদি-অন্ত আছে অর্থাৎ এ অনিত্য। সেইজন্য হে অর্জুন ! বুদ্ধিমান বিবেকশীল পুরুষ তাতে রত হন না। (5.22)
- যিনি দেহত্যাগ করবার পূর্বে কাম-ক্রোধ হতে উৎপন্ন বেগ সহ্য করতে সক্ষম হন, তিনিই যোগী এবং সুখী। (5.23)
- যিনি অন্তরাত্মাতেই সুখযুক্ত, আত্মারাম এবং আত্মাতেই জ্ঞানযুক্ত ; সেই সচ্চিদানন্দঘন পরব্রহ্ম পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত সাংখ্যযোগী ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্ত হন। (5.24)
- যাঁর সমস্ত পাপ দূর হয়েছে, সমস্ত সংশয় জ্ঞান দ্বারা ছিন্ন হয়েছে, যিনি সর্বভূতহিতে রত, সংযত চিত্ত ও নিশ্চলভাবে পরমাত্মাতে স্থিত—সেই ব্রহ্মবেত্তা পুরুষ শান্তস্বরূপ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। (5.25)
- কাম-ক্রোধ হতে মুক্ত সংযতচিত্ত, ব্রহ্মদর্শী জ্ঞানী পুরুষের সর্বদিক পরিপূর্ণ করে শান্ত পরব্রহ্মই স্থিত আছেন। (5.26)
- বাহ্য বিষয়ভোগের চিন্তা না করে তাকে বাইরেই ত্যাগ করে, চোখের দৃষ্টি ভ্রমধ্যে স্থাপন করে, নাসিকার মধ্যে বিচরনশীল প্রাণ ও অপানবায়ুকে সম করে…(5.27)
- …এবং ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করে ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধশূন্য হয়ে যে মোক্ষপরায়ণ মুনি সর্বদা বিরাজ করেন, তিনি মুক্তই থাকেন। (5.28)
- আমার ভক্ত আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর (ঈশ্বরেরও ঈশ্বর) এবং সকল প্রাণীর সুহৃদ অর্থাৎ স্বার্থরহিত দয়ালু ও প্রেমিক, এইরূপ তত্ত্বতঃ জেনে শান্তি লাভ করেন। (5.29)
Chapter 6
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—যিনি কর্মফলের আশ্রয় না নিয়ে কর্তব্য-কর্ম করেন তিনিই সন্ন্যাসী এবং যোগী। যিনি কেবল যাগযজ্ঞাদিসম্পাদক বৈদিক অগ্নি ও লোকহিতকর ক্রিয়াদি ত্যাগ করেছেন তিনি যোগী বা সন্ন্যাসী নন। (6.1)
- হে অর্জুন ! যাকে সন্ন্যাস বলা হয়, তাকেই তুমি যোগ বলে জানবে কারণ সংকল্প ত্যাগ না করলে কেউই যোগী হতে পারে না। (6.2)
- যোগে আরোহণে ইচ্ছুক মননশীল ব্যক্তির যোগে স্থিতিলাভের জন্য নিষ্কাম কর্ম করাকেই কারণ বলা হয়েছে এবং যোগারূঢ় হলে যোগারূঢ় পুরুষের যে সর্বসংকল্পের অভাব হয়, সেটিকে তাঁর পরম কল্যাণের কারণ বলা হয়েছে। (6.3)
- যখন সাধক ইন্দ্রিয়সমূহের ভোগে আসক্ত হন না এবং কর্মেও আসক্ত হন না, তখন সেই সর্বসংকল্পত্যাগী পুরুষকে যোগারূঢ় বলা হয়। (6.4)
- নিজের দ্বারাই নিজেকে সংসার হতে উদ্ধার করবে এবং নিজেকে কখনও অধোগতির পথে যেতে দেবে না; কারণ মানুষ নিজেই নিজের বন্ধু আবার নিজেই নিজের শত্রু। (6.5)
- যে জীবাত্মার দ্বারা মন এবং ইন্দ্রিয়াদিসহ শরীর বশীভূত হয়েছে, সেই জীবাত্মা নিজেই নিজের বন্ধু এবং যে জীবাত্মার দ্বারা মন এবং ইন্দ্রিয়াদিসহ শরীর বশীভূত হয়নি, সে নিজেই নিজের শত্রু। (6.6)
- শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ এবং মান-অপমানে যাঁর চিত্ত পূর্ণরূপে শান্ত এইরূপ স্বাধীন-চিত্ত ব্যক্তি সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মায় সম্যকভাবে অবস্থান করেন অর্থাৎ তাঁর জ্ঞানে পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কিছুই থাকে না। (6.7)
- যাঁর অন্তঃকরণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিতৃপ্ত, যিনি বিকার রহিত এবং জিতেন্দ্রিয় ; যাঁর দৃষ্টিতে মৃত্তিকা, প্রস্তর এবং স্বর্ণ সমতুল্য, তিনিই যোগযুক্ত অর্থাৎ তাঁর ভগবৎ প্রাপ্তি হয়েছে বুঝতে হবে। (6.8)
- সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থা, দেষ্য, বন্ধু, ধর্মাত্মা এবং পাপীদের প্রতি যিনি সমভাব রাখেন, তিনিই প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠ। (6.9)
- মন ও ইন্দ্রিয়সহ যিনি সংযতদেহ, আকাঙ্ক্ষা এবং সঞ্চয়বৃত্তিশূন্য ; তিনি একাকী, নির্জন স্থানে থেকে নিরন্তর চিত্তকে পরমাত্মার ধ্যানে নিযুক্ত করবেন। (6.10)
- পবিত্র এবং অতি উচ্চে বা অতি নিম্নে নয় এমনস্থানে, ক্রমশঃ কুশ, মৃগচর্ম এবং বস্ত্রাদি পেতে নিজের স্থির আসন স্থাপন করবেন। (6.11)
- সেই আসনে বসে চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযত করে মনকে একাগ্র করে, অন্তঃকরণের শুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করবেন। (6.12)
- মেরুদণ্ড, মস্তক, গ্রীবাকে সমান ও নশ্চলভাবে স্থির করে, নিজ নাসিকার অগ্রভাগে স্থির দৃষ্টি স্থাপন করে, ব্রহ্মচর্য ব্রতে রত হয়ে, ভয় রোহিত ও প্রশান্তচিত্ত যোগী সতর্ক হয়ে মনকে সংযত করে মদ্গতচিত্ত এবং মৎপরায়ণ হয়ে অবস্থান করেন। (6.13 & 6.14)
- সংযতচিত্ত যোগী এইভাবে আত্মাকে নিরন্তর পরমেশ্বররূপ আমাতে সমাহিত করে আমাতে স্থিত পরমানন্দের পরাকাষ্ঠারূপ শান্তি লাভ করেন। (6.15)
- হে অর্জুন ! এই যোগ, যাঁরা অত্যধিক আহার করেন অথবা যাঁরা একান্ত অনাহারী, যাঁরা অতিশয় নিদ্রালু অথবা অত্যন্ত জাগরণশীল তাঁদের সিদ্ধ হয় না। (6.16)
- দুঃখনাশক এই যোগ নিয়মিত আহার-বিহারকারী, কর্মে যথাযথ চেষ্টাকারী এবং নিয়মিত নিদ্রা ও জাগরণশীলেরই সিদ্ধ হয় । (6.17)
- চিত্ত যখন একান্তভাবে বশীভূত হয়ে পরমাত্মাতেই অবস্থান করে তখন ভোগে সম্পূর্ণভাবে আকাঙ্ক্ষাশূন্য সেই পুরুষকে যোগযুক্ত বলা হয়। (6.18)
- বায়ুবিহীন স্থানে দীপশিখা যেমন চঞ্চল হয় না, পরমাত্মার ধ্যানে সংযতচিত্ত একাগ্রীভূত চিত্তেরও সেই অবস্থা জানবে। (6.19)
- যোগ অভ্যাসের দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত যে অবস্থায় নিবৃত্ত হয় এবং যে অবস্থায় পরমাত্মার ধ্যানে শুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যে পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করে যোগী পরমাত্মাতেই পরিতুষ্ট হন। (6.20)
- ইন্দ্রিয়াদির অতীত, কেবল পরিশুদ্ধ বুদ্ধিদ্বারা গ্রাহ্য যে অনন্ত আনন্দ আছে, যোগী এই অবস্থায় সেটি অনুভব করেন এবং সেই অবস্থায় স্থিত যোগী কোনোভাবেই পরমাত্মাস্বরূপ হতে আর বিচলিত হন না। (6.21)
- পরমাত্মাকে লাভ করে অন্য কিছুকে যোগী তা অপেক্ষা অধিক লাভজনক মনে করেন না এবং পরমাত্মাপ্রাপ্তিরূপ সেই অবস্থায় স্থিত হয়ে মহাদুঃখেও তা থেকে বিচলিত হন না। (6.22)
- তাকেই বলা হয় যোগ, এটি জানা চাই। এই যোগ অধৈর্য না হয়ে অর্থাৎ ধৈর্য ও উৎসাহযুক্ত চিত্তে নিশ্চয়পূর্বক অভ্যাস করা কর্তব্য। (6.23)
- সংকল্পজাত সমস্ত কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে সমস্ত বিষয় হতে নিবৃত্ত করে। (6.24)
- ধীরে ধীরে অভ্যাসের দ্বারা উপরতিতে স্থিত হবেন এবং ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধির দ্বারা মনকে পরমাত্মায় স্থাপন করে পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কিছুই চিন্তা করবে না। (6.25)
- এই অস্থির চঞ্চল মন যে যে বিষয়ের প্রতি ধাবিত সেই সেই বিষয় হতে তাকে প্রত্যাহার করে বারবার পরমাত্মাতেই স্থিত করবে। (6.26)
- কারণ যিনি প্রশান্তচিত্ত, পাপরহিত এবং রজোগুণ বৃত্তিশূন্য—এরূপ যোগী সচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরম আনন্দ লাভ করেন। (6.27)
- সেই নিষ্পাপ যোগী এইভাবে নিরন্তর আত্মাকে পরমাত্মায় সমাহিত করে অনায়াসে পরব্রহ্ম পরমাত্মাপ্রাপ্তিরূপ অনন্ত আনন্দ অনুভব করেন। (6.28)
- সর্বব্যাপী অনন্ত চেতনে একত্বভাবে যুক্ত তথা সর্বত্র সমদর্শনকারী যোগী স্বীয় আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে স্বীয় আত্মায় অনুভব করেন। (6.29)
- যিনি সর্বভূতে আত্মারূপে আমাকে (বাসুদেবকে) অবলোকন করেন এবং সর্বভূতকে আমাতে দেখেন তাঁর কাছে আমি অদৃশ্য হই না এবং তিনিও আমার কাছে অদৃশ্য হন না। (6.30)
- যে-ব্যক্তি অভেদভাবে স্থিত হয়ে সর্বভূতে আত্মারূপে আমাকে (সচ্চিদানন্দঘন বাসুদেবকে) ভজনা করেন, সেই যোগী সর্বপ্রকার ব্যবহার করলেও আমাতেই অবস্থান করেন। (6.31)
- হে অর্জুন ! যিনি সর্বত্র সমদর্শী হয়ে সকল ভূতের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলে অনুভব করেন, আমার মতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। (6.32)
- অর্জুন বললেন-হে মধুসূদন ! আপনি যে সমতারূপ যোগের কথা বললেন, মন চঞ্চল হওয়ায় আমি তার নিত্য স্থিতি দেখি না। (6.33)
- কারণ হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, বিক্ষোভকারী, দৃঢ় ও শক্তিশালী। তাই একে বশে রাখা আমি বায়ুকে নিরুদ্ধ করার মতো দুষ্কর বলে মনে করি। (6.34)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন –হে মহাবাহো ! মন নিঃসন্দেহে চঞ্চল এবং একে বশে রাখা দুস্কর। কিন্তু হে কুন্তীপুত্র অর্জুন ! অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা একে বশ করা যায়। (6.35)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন –হে মহাবাহো ! মন নিঃসন্দেহে চঞ্চল এবং একে বশে রাখা দুস্কর। কিন্তু হে কুন্তীপুত্র অর্জুন ! অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা একে বশ করা যায়। (6.36)
- অর্জুন বললেন—হে কৃষ্ণ ! যিনি যোগে শ্রদ্ধা রাখেন কিন্তু সংযতচিত্ত নন, সেইজন্য অন্তিম সময়ে (মৃত্যুকালে) যাঁর মন যোগ হতে বিচলিত হয়ে যায়, এইরূপ যোগী যোগসিদ্ধ না হয়ে অর্থাৎ পরমাত্মার সাক্ষাৎকার না করে কীরূপ গতি প্রাপ্ত হন ? (6.37)
- হে মহাবাহো ! তিনি কি ভগবৎপ্রাপ্তির পথে বিভ্রান্ত এবং নিরাশ্রয় হয়ে ছিন্ন-ভিন্ন মেঘখণ্ডের ন্যায় উভয় পথ হতে ভ্রষ্ট হয়ে বিনাশ প্রাপ্ত হন ? (6.38)
- হে কৃষ্ণ ! আমার এই সংশয় নিঃশেষে আপনিই দূর করতে সমর্থ ; কারণ আপনি ছাড়া আর কেউ এই সংশয় দূর করতে পারবে না। (6.39)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন –হে পার্থ ! সেই ব্যক্তির ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও বিনাশ নেই। কারণ হে বৎস ! কল্যাণকামী ব্যক্তির কখনও অধোগতি হয় না। (6.40)
- যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যাত্মাগণের প্রাপ্যলোক অর্থাৎ স্বর্গাদি উচ্চলোকে বহুকাল বাস করে পুনঃ সদাচার সম্পন্ন ধনীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। (6.41)
- অথবা যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেইসকল লোকাদিতে না গিয়ে জ্ঞানবান যোগীর কুলে জন্মগ্রহণ করেন। এইরূপ জন্ম জগতে অত্যন্ত দুর্লভ। (6.42)
- তিনি (শ্রীসম্পন্ন সদাচারী ব্যক্তির গৃহে জন্মগ্রহণকারী) যোগভ্রষ্ট হয়েও পূর্ব জন্মের অভ্যাসবশে নিজের অবশেই ভগবানে আকৃষ্ট হন, তথা সমবুদ্ধিরূপ যোগের জিজ্ঞাসু ব্যক্তিও বেদে বর্ণিত সকাম কর্মের ফলকে অতিক্রম করেন। (6.43 & 6.44)
- কিন্তু যত্নপূর্বক অভ্যাসকারী যোগী বিগত বহু জন্মের সাধনসঞ্চিত সংস্কারের প্রভাবে এই জন্মেই পাপরহিত হয়ে যান এবং তৎকালেই পরমগতি লাভ করেন। (6.45)
- যোগী তপস্বিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত গণের হতেও শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মানুষ্ঠানকারিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। অতএব হে অর্জুন! তুমি যোগী হও। (6.46)
- সকল যোগীর মধ্যে যিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে মদ্গতচিত্তে নিরন্তর আমাকে ভজনা করেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী—এই আমার মত। (6.47)
Chapter 7
- শ্রীভগবান বললেন –হে পার্থ ! আমাতে আসক্তচিত্ত, আমার শরণাগত হয়ে যোগাভ্যাস দ্বারা তুমি আমার সমগ্র রূপ যে প্রকারে নিঃসন্দিগ্ধভাবে জানতে পারবে—তা শোনো। (7.1)
- তোমার জন্য আমি বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণরূপে বলছি, যেটি জানলে এ বিষয়ে কিছুই আর জানবার অবশিষ্ট থাকবে না। (7.2)
- সহস্র মানুষের মধ্যে কোনো একজন প্রকৃত সিদ্ধিলাভের জন্য চেষ্টা করেন এবং ওই যত্নশীল সিদ্ধ ব্যক্তিগণের মধ্যে কোনো একজন আমাকে যথার্থভাবে জানতে পারেন । (7.3)
- ক্ষিতি (পৃথিবী), জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ—এই পঞ্চমহাভূত এবং মন, বুদ্ধি, অহংকার- -এ হলো আট ভাগে বিভক্ত অপরা প্রকৃতি অর্থাৎ আমার জড় প্রকৃতি। (7.4)
- হে মহাবাহো ! এই অপরা প্রকৃতি থেকে ভিন্ন আমার জীবরূপা ‘পরা’ প্রকৃতি, যার দ্বারা এই জগৎ ধৃত হয়ে আছে জানবে। (7.5)
- অপরা ও পরা (জড় ও চেতন) এই উভয় প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন বলে জানবে এবং আমি সমস্ত জগতের উৎপত্তি এবং প্রলয়রূপ অর্থাৎ সমগ্র জগতের মূলকারণ। (7.6)
- হে ধনঞ্জয় ! আমি ভিন্ন এই জগতের অন্য কোনো কারণ বা কার্য নেই। যেমন সুতোর দ্বারা তৈরি মালায় মণিসমূহ সুতোতে গাঁথা থাকে, তেমনি সমস্ত জগৎ আমাতেই অনুস্যূত (ওতঃপ্রোত) হয়ে আছে। (7.7)
- হে কৌন্তেয় ! জলে আমি রস, চন্দ্র ও সূর্যে আমি প্রভা, বেদে আমি প্রণব (ওঁকার), আকাশে আমি শব্দ এবং মানুষের মধ্যে আমি পুরুষার্থরূপে বিরাজমান। (7.8)
- আমিই পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধ, অগ্নিতে তেজ, সমস্ত প্রাণীর জীবনীশক্তি এবং তপস্বীদের তপস্যা। (7.9)
- হে পার্থ ! আমাকে সর্ব প্রাণীর অনাদি বীজ বলে জানবে। আমি বুদ্ধিমানদিগের বুদ্ধি এবং তেজস্বিগণের তেজস্বরূপ। (7.10)
- হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন ! বলবানদিগের কাম ও রাগবর্জিত বল আমি। মানুষের মধ্যে ধর্মের অবিরুদ্ধ (ধর্মসম্মত) কামও আমি। (7.11)
- যতপ্রকার সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক ভাব আছে, সে-সব আমা হতে উৎপন্ন বলে জানবে। কিন্তু আমি সেই সবে নেই এবং সেগুলিও আমাতে নেই। (7.12)
- এই তিনটি গুণরূপ ভাবের দ্বারা মোহিত সমগ্র জগৎ এইসব গুণের অতীত অবিনাশী ঈশ্বররূপে আমাকে জানতে পারে না। (7.13)
- কারণ আমার এই গুণময়ী দৈবী মায়া অত্যন্ত দুরত্যয় অর্থাৎ পার হওয়া কঠিন। যাঁরা শুধুমাত্র আমার শরণাগত হন, তাঁরা এই মায়া অতিক্রম করতে পারেন ৷ (7.14)
- মায়া দ্বারা হতজ্ঞানী, আসুরীভাবের আশ্রয়গ্রহণকারী, মনুষ্যকুলে অতিশয় নীচ এবং পাপাচরণকারী মৃঢ় ব্যক্তি আমার শরণ নেয় না। (7.15)
- হে ভরতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! অর্থার্থী(জাগতিক পদার্থের জন্য উপাসনাকারী), আর্ত (সঙ্কটমুক্তির আশায় উপাসনাকারী), জিজ্ঞাসু (আমাকে যথার্থরূপে জানার ইচ্ছায় উপাসনাকারী) এবং জ্ঞানী–এই চার-প্রকারের সুকৃতিশালী মানুষ আমার ভজনা করে অর্থাৎ আমার শরণাগত হয়। (7.16)
- ওই চারপ্রকার ভক্তের মধ্যে সতত আমাতে সমাহিতচিত্ত অনন্য ভক্তিসম্পন্ন জ্ঞানী অতিশয় শ্রেষ্ঠ। কারণ জ্ঞানী ভক্তের নিকট আমি অতি প্রিয় এবং সেও আমার অতিশয় প্রিয়। (7.17)
- পূর্বে কথিত সকল ভক্তই অত্যন্ত মহান (শ্রেষ্ঠ ভাবসম্পন্ন)। কিন্তু জ্ঞানী তো আমার আত্মস্বরূপ —এই হল আমার মত। কারণ সে মদ্গতচিত্ত এবং যার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কোনো গতি নেই,সেই আমাতেই সে দৃঢ় আস্থাবান। (7.18)
- অনেক জন্মের পরে অন্তিম জন্মে অর্থাৎ মনুষ্যজন্মে ‘পরমাত্মাই সবকিছু, এইভাবে যে জ্ঞানী ব্যক্তি আমার শরণাগত হন, সেইরূপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ। (7.19)
- ভোগাদি কামনা দ্বারা যাদের বিবেক অপহৃত হয়েছে তারা নিজ নিজ প্রকৃতির (স্বভাবের) বশীভূত হয়ে অন্য দেবতাদের শরণাগত হয়ে তাদের (আরাধনার) নিয়মগুলি পালন করে থাকে। (7.20)
- যে যে ভক্ত যে যে দেবতার পূজা করতে ইচ্ছুক, আমি সেই সেই দেবতার প্রতি তার ভক্তি অচলা করে দিই। (7.21)
- ওই (আমা দ্বারা দৃঢ়ীকৃত) শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে ওই ব্যক্তি (সকামভাবে) ওই দেবতার উপাসনা করে এবং তার কামনার পূরণও হয়। কিন্তু সেই কামনা-পূর্তি আমা কর্তৃকই বিহিত হয়ে থাকে। (7.22)
- কিন্তু সেই অল্পবুদ্ধি মানুষদের ওইসকল দেবতাদের আরাধনার ফল বিনাশশীল হয়ে থাকে। দেবতাদের পূজা করেন যাঁরা, তাঁরা দেবতাদের লাভ করেন আর আমার ভক্তগণ আমাকেই লাভ করেন। (7.23)
- অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার সর্বোৎকৃষ্ট পরমভাব না জেনে অব্যক্ত (মন-ইন্দ্রিয়াদির অতীত) আমাকে, সচ্চিদানন্দময় পরমাত্মাকে, মানুষের ন্যায় শরীর ধারণকারী বলে মনে করে থাকে। (7.24)
- নিজ যোগমায়ার দ্বারা আবৃত বলে আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হই না, তাই এই সব মূঢ় ব্যক্তিগণ জন্মরাহিত অবিনাশী পরমেশ্বর আমাকে জানতে পারে না, অর্থাৎ আমাকে জন্ম-মরণশীল বলে মনে করে। (7.25)
- হে অর্জুন! যারা অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে, সেই সকল প্রাণীকে আমি জানি। কিন্তু আমাকে (ভক্ত ব্যতীত) কেউই জানে না। (7.26)
- হে ভরতবংশোদ্ভব পরন্তপ ! ইচ্ছা (আকাঙ্ক্ষা) এবং দ্বেষ হতে উৎপন্ন দ্বন্দ্ব-মোহ দ্বারা মোহিত সমস্ত প্রাণী অনাদিকাল থেকে জগতে হতজ্ঞান অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (7.27)
- কিন্তু যে পুণ্যকর্মা ব্যক্তিদের পাপ বিনষ্ট হয়েছে, সেই দ্বন্দ্ব- মোহরহিত দৃঢ় ব্রত ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন। (7.28)
- বৃদ্ধাবস্থা এবং মরণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য যাঁরা আমার শরণাগত হয়ে প্রযত্ন করেন, তাঁরা সেই সনাতন ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যায় বিষয় এবং সম্পূর্ণ কর্মতত্ত্ব অবগত হন। (7.29)
- যেসব মানুষ অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞসহ আমাকে জানেন, তাঁরা যুক্তচিত্ত হওয়ায় মৃত্যুকালেও আমাকে জানতে পারেন অর্থাৎ আমাকেই প্রাপ্ত হন। (7.30)
Chapter 8
- …..
Chapter 11
- অর্জুন বললেন—হে ভগবান ! আমার প্রতি অনুগ্রহ করে আপনি যে পরম গুহ্য অধ্যাত্মতত্ত্ব বললেন, তাতে আমার মোহ দূর হয়েছে। (11.1)
- কারণ হে কমললোচন ! আমি আপনার কাছে ভূতগণের উৎপত্তি ও বিনাশ সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে শুনেছি এবং আপনার অক্ষয় মাহাত্ম্যও জেনেছি। (11.2)
- হে পরমেশ্বর ! আপনি যে আত্মতত্ত্ব বলছেন, তা যথার্থ ; কিন্তু হে পুরুষোত্তম ! আমি আপনার জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য এবং তেজঃসমন্বিত ঈশ্বরীয় বিশ্বরূপ দেখতে ইচ্ছা করি। (11.3)
- হে প্রভু ! আমাকে যদি আপনার সেই বিশ্বরূপ দেখার যোগ্য বলে মনে করেন, তা হলে হে যোগেশ্বর ! আমাকে আপনার সেই অবিনাশী স্বরূপ দেখান। (11.4)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—হে পার্থ ! তুমি আমার বহুবিধ এবং নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত এবং সহস্র সহস্র দিব্যরূপ দর্শন করো। (11.5)
- হে ভরতবংশীয় অর্জুন ! তুমি আমার মধ্যে দ্বাদশ আদিত্য (অদিতির পুত্রদের), অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও ঊনপঞ্চাশ মরুদ্গণ (বায়ু)কে দর্শন করো এবং পূর্বে যা কখনও দেখোনি এরূপ বহু আশ্চর্যময় রূপ দর্শন করো। (11.6)
- হে অর্জুন ! আমার এই বিরাট শরীরে একস্থানে অবস্থিত চরাচরসহ সমগ্র জগৎ অবলোকন করো এবং আরও যা কিছু তোমার দেখবার ইচ্ছা তা-ও দেখো। (11.7)
- কিন্তু তুমি নিজ চর্ম চক্ষুর দ্বারা আমার এই বিশ্বরূপ দেখতে সমর্থ হবে না ; সেইজন্য আমি তোমাকে দিব্য চক্ষু প্রদান করছি, সেই চক্ষু দ্বারা তুমি আমার ঈশ্বরীয় যোগশক্তি দর্শন করো। (11.8)
- সঞ্জয় বললেন—হে রাজন্ ! মহাযোগেশ্বর এবং সর্বপাপনাশকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলে অর্জুনকে নিজের পরম ঐশ্বর্যযুক্ত দিব্যরূপ দেখালেন। (11.9)
- সেই বিশ্বরূপ অনেক মুখ ও অনেক নেত্রযুক্ত, অসংখ্য অদ্ভুত আকৃতি বিশিষ্ট, বহু দিব্যভূষণাদি পরিহিত এবং বহু দিব্য আয়ুধে সজ্জিত,…. (11.10)
- …দিব্য মাল্য এবং দিব্য বস্ত্রে ভূষিত, দিব্যগন্ধ অনুলিপ্ত, সর্বাশ্চর্যযুক্ত, অনন্ত ও সর্বতোমুখ—সেই বিশ্বরূপ পরমদেব পরমেশ্বরকে অর্জুন দর্শন করলেন। (11.11)
- সহস্র সূর্য একসঙ্গে আকাশে উদিত হলে যে প্রকাশ উৎপন্ন হয়, সেই প্রকাশও বিশ্বরূপ পরমাত্মার প্রকাশের কিঞ্চিৎ তুল্য হতে পারে। (11.12)
- পাণ্ডুপুত্র অর্জুন সেই নানা ভাগে বিভক্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দেবাদিদেব ভগবান একস্থানে অবস্থিত দেখলেন। (11.13)
- এরপর বিস্ময়াবিষ্ট রোমাঞ্চিত অর্জুন বিশ্বরূপধারী ভগবানকে শ্রীকৃষ্ণের শরীরে শ্রদ্ধা-ভক্তিসহ নতমস্তকে প্রণাম করে করজোড়ে বললেন। (11.14)
- অর্জুন বললেন—হে দেব ! আপনার শরীরে আমি সমস্ত দেবতা এবং বহুবিধ ভূত সমুদয়, কমলাসনে অধিষ্ঠিত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে, মহাদেবকে এবং সমস্ত ঋষি ও দিব্য সর্পগণকে দেখতে পাচ্ছি। (11.15)
- হে বিশ্বপতি ! আপনার বহু বাহু, বহু উদর, বহু মুখ এবং বহু নেত্র বিশিষ্ট এবং সব দিকেই অনন্তরূপযুক্ত বিরাট মূর্তি দেখছি। হে বিশ্বরূপ ! আমি আপনার অন্ত, মধ্য এবং আদি দেখতে পাচ্ছি না। (11.16)
- আপনাকে আমি কিরীটি, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিমান, তেজঃপুঞ্জরূপ, প্রজ্বলিত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় জ্যোতিসম্পন্ন, দুর্নিরীক্ষ্য এবং সর্বত্র অপ্রমেয়স্বরূপ দেখছি। (11.17)
- আপনি পরম ব্রহ্ম ও একমাত্র জ্ঞাতব্য। আপনি জগতের পরম আশ্রয় ও সনাতন ধর্মের রক্ষক, আপনিই অবিনাশী সনাতন পুরুষ, এই আমার মত। (11.18)
- আপনাকে আমি আদি, মধ্য ও অন্তহীনরূপে দেখছি, আপনি অনন্ত শক্তিসম্পন্ন ও অসংখ্য বাহুবিশিষ্ট, চন্দ্র ও সূর্য আপনার নেত্র, মুখ প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় এবং স্বীয় তেজে এই বিশ্বকে আপনি সন্তপ্ত করছেন। (11.19)
- হে মহাত্মন্ ! স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যবর্তী অন্তরীক্ষ এবং সর্বদিক আপনি পরিব্যাপ্ত করে আছেন। আপনার এই অলৌকিক ও উগ্র রূপ দেখে ত্রিলোক অত্যন্ত ভীত হচ্ছে। (11.20)
- ওই দেবগণ আপনাতেই প্রবিষ্ট হচ্ছেন । কেউ কেউ ভীত হয়ে করজোড়ে আপনার গুণগান করছেন এবং মহর্ষি ও সিদ্ধগণ ‘জগতের কল্যাণ হোক’ বলে বহু স্তুতিবাক্য দ্বারা আপনার স্তব করছেন। (11.21)
- একাদশ রুদ্র ও দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, সাধ্যগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, মরুদ্গণ, পিতৃগণ এবং গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও সিদ্ধগণ সকলেই বিস্মিত হয়ে আপনাকে দেখছেন। (11.22)
- হে মহাবাহো ! আপনার বহু মুখ, বহু চক্ষু, বহু বাহু, বহু উরু, বহু চরণ, বহু উদর এবং ভয়ানক দন্তযুক্ত বিকট রূপ দেখে সমস্ত লোক অত্যন্ত ভীত হচ্ছে এবং আমিও অতিশয় ভীত হচ্ছি। (11.23)
- কারণ হে বিষ্ণো ! আকাশস্পর্শকারী, তেজোময়, নানাবর্ণবিশিষ্ট, বিস্ফারিত মুখমণ্ডল তথা জাজ্বল্যমান বিশাল চক্ষুবিশিষ্ট আপনাকে দেখে আমি ভীত হচ্ছি এবং ধৈর্য ও শান্তি পাচ্ছি না। (11.24)
- বিকট দন্তদ্বারা বিকৃত এবং প্রলয়াগ্নিসম প্রজ্বলিত আপনার মুখ দেখে আমি দিশাহারা হচ্ছি, শান্তি পাচ্ছিনা। হে দেবেশ ! হে জগন্নিবাস ! আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। (11.25)
- রাজন্যবর্গসহ ঐসব ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ এবং পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ এবং আমাদের পক্ষের প্রধান যোদ্ধাগণসহ সকলেই…. (11.26)
- …আপনার দংষ্ট্রাকরাল ভীষণ মুখগহ্বরে সবেগে প্রবেশ করছেন। কারও চূর্ণিত মস্তক খণ্ড আপনার দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে রয়েছে দেখছি। (11.27)
- যেমন নদীসমূহের বহু জলপ্রবাহ সমুদ্রাভিমুখে যায় অর্থাৎ দ্রুতবেগে সমুদ্রে প্রবেশ করে, তেমনই এই বীরপুরুষগণও আপনার প্রজ্বলিত মুখবিবরে প্রবেশ করছেন। (11.28)
- যেমন পতঙ্গগণ অতিবেগে ধাবিত হয়ে মরণের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, তেমনি এইসব লোকও মৃত্যুর জন্যই অতিবেগে ধাবমান হয়ে আপনার মুখগহ্বরে প্রবেশ করছেন। (11.29)
- আপনি সকল লোককে জ্বলন্ত মুখবিবরে গ্রাস করে সব দিকে জিহ্বা দ্বারা লেহন করছেন। হে বিষ্ণো ! আপনার তীব্র প্রভা সমস্ত জগৎকে তেজোরাশি দ্বারা পূর্ণ করে সন্তপ্ত করছে। (11.30)
- …..
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—আমি লোকনাশকারক প্রবৃদ্ধ কাল। এখন এই লোক সংহার করতে প্রবৃত্ত হয়েছি। তুমি যদি যুদ্ধ না-ও করো, প্রতিপক্ষের যোদ্ধাগণ কেউই জীবিত থাকবে না অর্থাৎ এঁদের বিনাশ হবেই। (11.32)
- অতএব তুমি যুদ্ধার্থে উত্থিত হও ও যশ লাভ করো এবং শত্রু জয় করে ধন-ধান্যসম্পন্ন রাজ্য ভোগ করো। এই যোদ্ধাদের আমি পূর্বেই বধ করেছি। হে সব্যসাচী ! তুমি কেবল নিমিত্তমাত্র হও। (11.33)
- ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধাদের আমি পূর্বেই নিহত করেছি, সেই মৃতদেরই তুমি বধ করো। ভয় করো না। তুমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে শত্রুদের জয় করবে। অতএব যুদ্ধ করো । (11.34)
- সঞ্জয় বললেন—কেশবের এই কথা শুনে মুকুটধারী অর্জুন কম্পিত দেহে হাত জোড় করে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন এবং অত্যন্ত ভীত হয়ে পুনরায় প্রণাম করে গদগদ স্বরে বললেন। (11.35)
- অর্জুন বললেন—হে হৃষীকেশ ! আপনার মাহাত্ম্য কীর্তনে সমস্ত জগৎ আনন্দিত ও আপনার প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাক্ষসেরা নানাদিকে ধাবিত হচ্ছে ও সিদ্ধগণ আপনাকে নমস্কার জানাচ্ছেন। এই সমস্ত খুবই যুক্তিযুক্ত। (11.36)
- আপনাকে কেনই বা সকলে প্রণাম করবে না ? হে অনন্ত ! হে দেবেশ ! হে জগন্নিবাস ! যা সৎ, যা অ-সৎ তাও আপনি এবং এই উভয়ের অতীত যে সচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্ম, তাও আপনি। (11.37)
- আপনি আদিদেব ও অনাদি পুরুষ, আপনি এই জগতের পরম আশ্রয় এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞাতব্য, আপনি পরমধাম। হে অনন্তরূপ ! আপনিই জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে আছেন। (11.38)
- আপনি বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ; আপনি প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং ব্রহ্মারও পিতা। আপনাকে সহস্রবার প্রণাম করি। আপনাকে পুনরায় প্রণাম করি। আপনাকে বারবার প্রণাম করি। (11.39)
- হে অনন্ত সামর্থ্যসম্পন্ন ! আপনাকে সম্মুখে প্রণাম, পশ্চাতে প্রণাম ! সর্বদিক হতে প্রণাম। হে সর্বাত্মনু ! অসীম পরাক্রমশালী আপনি সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত করে আছেন, অতএব আপনিই সর্বস্বরূপ। (11.40)
- আপনার এই মাহাত্ম্য না জেনে আপনাকে সখা মনে করে প্রণয়বশতঃ বা প্রমাদবশতঃ আমি ‘হে কৃষ্ণ !” “হে যাদব !” “হে সখে !’—এই বলে অবুঝের মতো আপনাকে সম্বোধন করেছি। (11.41)
- হে অচ্যুত, উপহাসচ্ছলে আহার, বিহার, আসন এবং শয়নের সময় একাকী বা অন্য সখাদের সমক্ষে আপনাকে যে অমর্যাদা করেছি, হে অপ্রমেয় ! সেইসব অপরাধের জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি। (11.42)
- …….
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—তুমি আমার যে চতুর্ভুজ রূপ দর্শন করেছ তার দর্শন পাওয়া বড়ই দুর্লভ। দেবতাগণও সর্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী। (11.52)
- আমার যে বিশ্বরূপের দর্শন তুমি করেছ তা বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, দান বা যজ্ঞের দ্বারাও সম্ভব নয়। (11.53)
- হে পরন্তপ অর্জুন ! একনিষ্ঠ ভক্তি দ্বারাই এই প্রকার আমাকে জানতে ও স্বরূপতঃ প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্রবিষ্ট হতে অর্থাৎ একাত্বরূপে লাভ করতে ভক্তগণ সমর্থ হয়, অন্য উপায়ে নয়। (11.54)
- হে অর্জুন ! যে-ব্যক্তি আমারই জন্য সমস্ত কর্ম করেন, আমার পরায়ণ হন, আমার ভক্ত হন, আসক্তিশূন্য হন এবং সমস্ত প্রাণীতে বৈরভাব শূন্য হন,—সেই অনন্য ভক্তিযুক্ত পুরুষ আমাকেই প্রাপ্ত হন। (11.55)
Chapter 16
- হে পার্থ ! দম্ভ, দৰ্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞান—এই সকল হল আসুরী সম্পদসহ জাত পুরুষদের লক্ষণ। (16.4)
- দৈবী সম্পদ সংসারবন্ধন হতে মুক্তি হেতু এবং আসুরী সম্পদ সংসার বন্ধনের কারণ। হে পাণ্ডব !তুমি শোক করো না, কারণ তুমি দৈবী সম্পদ নিয়ে জন্মেছ। (16.5)
- হে পার্থ ! ইহলোকে দুই প্রকারের মানুষ সৃষ্টি হয়েছে, এক দৈবী প্রকৃতিসম্পন্ন এবং অপরটি আসুরী প্রকৃতিসম্পন্ন। এদের মধ্যে দৈবী প্রকৃতিসম্পন্ন মানুষদের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছি, এইবার আসুরী প্রকৃতিসম্পন্ন মানুষদের কথা বিস্তারিতভাবে আমার নিকট শোনো। (16.6)
- আসুরী স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তিগণ প্রবৃত্তি এবং নিবৃত্তি –এই দুটিকেই জানে না। তাই তাদের মধ্যে বাহ্যাভ্যন্তর শুদ্ধি নেই, সদাচার নেই এবং সত্যভাষণও নেই। (16.7)
- এই আসুরী প্রকৃতির মানুষেরা বলে এই জগৎ ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন, সত্যশূন্য এবং কর্মফলদাতা ঈশ্বর বলে কেউ নেই। শুধু কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই এ উৎপন্ন, এছাড়া আর কিছুই নেই। (16.8)
- এইরূপ মিথ্যা জ্ঞান অবলম্বন করে বিকৃত স্বভাব এবং মন্দবুদ্ধিসম্পন্ন, অহিতকারী ক্রূরকর্মা ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে। (16.9)
- এইসব দুম্পূরণীয় বাসনায় পূর্ণ, দম্ভ, অভিমান ও মদযুক্ত মানুষেরা অজ্ঞানবশতঃ অশুচি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভ্রষ্টাচারে প্রবৃত্ত হয়ে সংসারে বিচরণ করে। (16.10)
- মৃত্যুকাল পর্যন্ত এরা অসংখ্য চিন্তার আশ্রয় নিয়ে বিষয়ভোগে রত থাকে ও ‘এই-ই সুখ’ এইরূপ মনে করে থাকে। (16.11)
- তারা অসংখ্য আশা অর্থাৎ কামনার জালে আবদ্ধ থেকে এবং কাম ও ক্রোধের অধীন হয়ে বিষয়ভোগের জন্য অসৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহে রত থাকে। (16.12)
- তারা ভাবতে থাকে যে আজ আমার এই ধন লাভ হল, ভবিষ্যতে আমার এই আশা পূরণ হবে। আমার এত ধন আছে, পরে আরও ধন লাভ হবে। (16.13)
- সেই দুর্জয় শত্রুকে আমি নাশ করছি, এইবার অন্যান্যদেরও নাশ করব। আমি ঈশ্বর, আমি ভোগী। আমি পুরুষার্থসম্পন্ন, বলবান এবং সুখী। (16.14)
- আমি অত্যন্ত ধনী এবং অনেক আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত, আমার মতো আর কে আছে ? আমি যজ্ঞ করব, দান করব, আমোদ-প্রমোদ করব। (16.15)
- এইপ্রকার অজ্ঞ, মোহগ্রস্ত এবং নানাভাবে বিভ্রান্তচিত্ত মোহজাল সমাবৃত এবং বিষয়ভোগে অত্যধিক আসক্ত আসুরী প্রকৃতির ব্যক্তিগণ ভয়ানক অপবিত্র নরকে পতিত হয়। (16.16)
- নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে সেইসকল অহঙ্কারী ব্যক্তি ধন, মান ও গর্বের সঙ্গে অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে। (16.17)
- অহঙ্কার, বল, দর্প, কামনা ও ক্রোধের বশবর্তী এবং অপরের নিন্দাকারী এইরূপ ব্যক্তি নিজের অপরের দেহে অন্তর্যামীরূপে অবস্থিত আমার প্রতি দ্বেষভাব পোষণ করে। (16.18)
- সেই দ্বেষপরায়ণ, পাপাচারী, ক্রূর, নরাধমদের আমি এই সংসারে বারংবার আসুরী যোনিতে নিক্ষেপ করি। (16.19)
- হে অর্জুন ! সেই মূঢ় ব্যক্তিগণ আমাকে প্রাপ্ত না হয়ে জন্মান্তরে আসুরী-যোনি প্রাপ্ত হয় এবং ক্রমে তা থেকেও অত্যন্ত নিম্নগতি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ ঘোর নরকে পতিত হয়। (16.20)
- কাম, ক্রোধ এবং লোভ—এই তিনটি নরকের দ্বার স্বরূপএবং আত্মার হননকারী অর্থাৎ আত্মাকে অধোগামী করে। অতএব এই তিনটি বিষবৎ ত্যাগ করা উচিত। (16.21)
- হে অর্জুন ! এই তিন নরকের দ্বার হতে মুক্ত ব্যক্তি নিজ কল্যাণ সাধনে সমর্থ হন । সেইজন্য তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন অর্থাৎ আমাকে লাভ করেন। (16.22)
- যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে খুশিমতো আচরণ করে, সে সিদ্ধি লাভ করে না,মোক্ষলাভ করে না এবং সুখও প্রাপ্ত হয় না। (16.23)
- কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে তোমার নিকট শাস্ত্রই প্রমাণ। অতএব কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রবিধি জেনে তোমার কর্ম করা উচিত। (16.24)
Chapter 18
- অর্জুন বললেন—হে মহাবাহো ! হে অন্তর্যামী ! হে বাসুদেব ! আমি সন্ন্যাস এবং ত্যাগের তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি। (18.1)
- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—পণ্ডিতগণের কেউ কেউ কাম্য কর্মের) ত্যাগকেই সন্ন্যাস বলে জানেন, আবার অন্য বিচারশীল ব্যক্তি সর্ববিধ কেউ কর্মের ফল ত্যাগকেই ত্যাগ বলে থাকেন। (18.2)
- কোনো কোনো বিদ্বান ব্যক্তি বলেন যে সমস্ত কর্মই দোষযুক্ত, অতএব সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা উচিত ; আবার অন্য কোনো কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন যে যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। (18.3)
- হে পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন! সন্ন্যাস এবং ত্যাগ, এই দুটির মধ্যে প্রথমে তুমি ত্যাগের বিষয়ে আমার মত শোনো। ত্যাগ তিন প্রকারের বলা হয়েছে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। (18.4)
- যজ্ঞ, দান এবং তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়, বরং এই সকল কর্ম করাই উচিত। কারণ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা -এই তিনটিই বুদ্ধিমান পুরুষদের পবিত্র করে। (18.5)
- অতএব, হে পার্থ ! যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম এবং অন্যান্য সকল কর্তব্য-কর্ম, আসক্তি ও ফল কামনা ত্যাগ করে অবশ্যই করা উচিত ; এই হল আমার নিশ্চিত ও উত্তম মত। (18.6)
- (নিষিদ্ধ এবং কাম্যকর্ম ত্যাগ করাই উচিত) কিন্তু অবশ্যকর্তব্য নিত্য কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ, নিত্যকর্ম চিত্ত শুদ্ধিকর। মোহবশতঃ নিত্যকর্ম ত্যাগ করাকে তামস ত্যাগ বলা হয়। (18.7)
- কর্ম দুঃখকর, এই মনে করে যিনি দৈহিক ক্লেশের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করেন, তিনি এইরূপ রাজস ত্যাগ করে ত্যাগের ফল মোক্ষ লাভ করতে পারেন না। (18.8)
- হে অর্জুন ! শাস্ত্রবিহিত কর্ম করা কর্তব্য—এই ভাব নিয়ে আসক্তি ও ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কর্ম করাকে সাত্ত্বিক ত্যাগ বলে। (18.9)
- যে-ব্যক্তি অশুভ কর্মে দ্বেষ করেন না এবং শুভ কর্মে আসক্ত হন না—সেই সত্ত্বগুণযুক্ত ব্যক্তিই সংশয়রহিত, বুদ্ধিমান এবং প্রকৃত ত্যাগী। (18.10)
- কারণ দেহাভিমানী মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা সম্ভব নয় ; তাই যিনি কর্মফল ত্যাগ করেন, তাঁকেই ত্যাগী বলা হয়। (18.11)
- যারা ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে না; তাদের ভালো, মন্দ এবং ভালো-মন্দ মিশ্রিত—এইরূপ তিন প্রকারের কর্মফল মৃত্যুর পরেও ভোগ করতে হয় । কিন্তু যাঁরা কর্মফল ত্যাগ করেছেন তাঁদের কোনো কালেই কর্মফল ভোগ করতে হয় না। (18.12)
- হে মহাবাহো ! সমস্ত কর্মের সিদ্ধির এই পাঁচটি হেতু, কর্মবন্ধন হতে মুক্তির উপায় নির্দেশক সাংখ্যশাস্ত্রে যেভাবে কথিত হয়েছে, সেইগুলি তুমি আমার নিকট ভালোভাবে শোনো। (18.13)
- এই বিষয়ে অর্থাৎ কর্মের সিদ্ধিতে অধিষ্ঠান (১), কর্তা, বিবিধ প্রকারের করণ, (২) নানাবিধ চেষ্টা এবং পঞ্চম কারণ হল দৈব (৩)। (18.14)
- শরীর, মন ও বাক্যের দ্বারা মানুষ শাস্ত্রীয় বা অশাস্ত্রীয় যা-কিছু কর্ম করে এই পাঁচটি হল তার কারণ। (18.15)
- এতৎসত্ত্বেও যে-ব্যক্তি অশুদ্ধবুদ্ধি হেতু ঐ কর্ম সম্পাদনে শুদ্ধস্বরূপ আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে, সেই মলিন বুদ্ধিসম্পন্ন অজ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক ঠিক বোঝে না। (18.16)
- যে-ব্যক্তির অন্তঃকরণে ‘আমি কর্তা’ এই ভাব নেই এবং যাঁর বুদ্ধি সাংসারিক পদার্থ এবং কর্মে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সকলকে হত্যা করলেও প্রকৃতপক্ষে হত্যা করেন না এবং পাপেও লিপ্ত হন না। (18.17)
- জ্ঞাতা, জ্ঞান, জ্ঞেয়—এই তিনটি হল সকল কর্ম প্রবৃত্তির হেতু এবং কর্তা(৬), করণ, ক্রিয়া এই তিনটি হল কর্মসংগ্রহ। (18.18)
- সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তাকে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণের ভেদ অনুসারে তিন প্রকারের বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেইগুলিও তুমি যথাযথভাবে আমার নিকট শোনো। (18.19)
- যে-জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুধা বিভক্ত সর্বভূতে অবস্থিত এক অবিনাশী পরমাত্মতত্ত্বকে অবিভক্তরূপে দেখে, সেই জ্ঞানকে তুমি সাত্ত্বিক জ্ঞান বলে জানবে। (18.20)
- কিন্তু যে-জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুধা-বিভক্ত সমস্ত ভূতে অবস্থিত নানা ভাবকে পৃথক পৃথক রূপে দেখে, সেই জ্ঞানকে রাজস জ্ঞান বলে জানবে। (18.21)
- যে-জ্ঞানের দ্বারা কোনো একটি কার্যরূপ দেহেই সম্পূর্ণের মতো আসক্তি জন্মায়, সেই যুক্তিবিহীন অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান বলে জানবে। (18.22)
- যে-কর্ম শাস্ত্রবিধির দ্বারা নির্দিষ্ট এবং কর্তৃত্বরহিত ব্যক্তির দ্বারা ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য তথা রাগ-দ্বেষ- -বর্জিত হয়ে করা হয় তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়। (18.23)
- কিন্তু বহু কষ্টসাধ্য, ফলকামনাযুক্ত বা অহঙ্কারযুক্ত পুরুষের দ্বারা যে কর্মের অনুষ্ঠান করা হয় তাকে রাজস কর্ম বলা হয়। (18.24)
- ভাবী শুভাশুভ ফল, ধনক্ষয়, শক্তিক্ষয়, পরপীড়া ও সামর্থ্যের বিচার না করে কেবল অবিবেকবশতঃ যে কর্ম করা হয়, তাকে তামস কর্ম বলা হয়। (18.25)
- ফলে অনাসক্ত, কর্তৃত্বাভিমানরহিত, ধৈর্যশীল, উদ্যমযুক্ত এবং ক্রিয়মান কর্মের সিদ্ধিতে হর্ষহীন ও অসিদ্ধিতে বিষাদরহিত কর্তাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলা হয়। (18.26)
- বাসনাকুলচিত্ত, কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, পরদ্রব্যে লোভী, পরপীড়ক, বাহ্যান্তর শৌচহীন, ইষ্টপ্রাপ্তিতে হর্ষযুক্ত এবং অনিষ্ট প্রাপ্তিতে বিষাদযুক্ত—এইরূপ কর্তাকে রাজস কর্তা বলা হয়। (18.27)
- বিক্ষিপ্তচিত্ত, অত্যন্ত অসংস্কৃত বুদ্ধি, অনম্র, ধূর্ত, পরবৃত্তিনাশক, সদা বিষণ্ন, অলস ও দীর্ঘসূত্রী কর্তাকে তামস কর্তা বলা হয়। (18.28)
- হে ধনঞ্জয় ! সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণানুসারে বুদ্ধি ও ধৃতির তিন প্রকারের ভেদ পৃথক পৃথক ভাবে বলছি শোনো। (18.29)
- হে পার্থ ! যে-বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কর্তব্য ও অকর্তব্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মোক্ষ ঠিকমতো বুঝতে পারা যায়, তা হল সাত্ত্বিকী বুদ্ধি। (18.30)
- হে পৃথানন্দন ! যে-বুদ্ধি ধর্ম-অধর্ম এবং কর্তব্য অকর্তব্য সম্বন্ধে যথাযথ জানে না তা হল রাজসী বুদ্ধি। (18.31)
- হে পার্থ! যে-বুদ্ধি তমোগুণে সমাবৃত হয়ে অধর্মকে ‘ধর্ম” মনে করে এবং সমস্ত বিষয়েই বিপরীত অর্থ করে, তা হল তামসী বুদ্ধি। (18.32)
- হে পার্থ ! যে অব্যভিচারিণী ধারণাশক্তিতে মানুষ ধ্যানযোগের দ্বারা মন-প্রাণ-ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া ধারণ করে, তাকে সাত্ত্বিকী ধৃতি বলে। (18.33)
- কিন্তু, হে পৃথাপুত্র অর্জুন ! ফলাসক্ত মানুষ যে ধারণাশক্তির দ্বারা অত্যন্ত আসক্তিপূর্বক ধর্ম, অর্থ ও কামনাকে ধারণ করে, তাকে রাজসী ধৃতি বলে। (18.34)
- হে পার্থ ! দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যে ধারণাশক্তির দ্বারা নিদ্রা-ভয়-শোক-অবসাদ ও মদ ত্যাগ করে না অর্থাৎ এইগুলিকে ধরে রাখে তাকে তামসী ধৃতি বলে। (18.35)
- হে ভরতশ্রেষ্ঠ ! তিনপ্রকার সুখের বিষয় এইবার তুমি আমার নিকট শোনো। যে সুখে মানুষ ভজন, ধ্যান এবং সেবাদির অভ্যাসের দ্বারা প্রীত ও পরিতৃপ্ত হয় এবিং পরিণামে দুঃখ হতে সমারূপে মুক্ত হয়— এইরূপ সুখ, যা আরম্ভে বিষতুল্য মনে হলেও পরিণামে অমৃতের ন্যায় হয়ে থাকে; সেই পরমাত্ম বিষয়ক বুদ্ধির নির্মলতা হতে উৎপন্ন সুখকে সাত্ত্বিক সুখ বলা হয়। (18.36 & 18.37)
- যে-সুখ বিষয় ও ইন্দ্রিয়াদির সংযোগে হয়, যা ভোগকালের প্রারম্ভে অমৃতবৎ মনে হলেও পরিণামে বিষতুল্য(১) হয়—সেই সুখকে রাজস সুখ বলা হয়। (18.38)
- যে-সুখ ভোগকালে এবং পরিণামে আত্মাকে মোহগ্রস্ত করে—নিদ্রা, আলস্য এবং প্রমাদ হতে জাত সেই সুখকে তামস সুখ বলা হয়। (18.39)
- পৃথিবীতে বা স্বর্গে (মনুষ্য বা দেবতা) এমন কোনো প্রাণী বা বস্তু নেই, যা প্রকৃতি হতে উৎপন্ন এই তিন গুণ রহিত। (18.40)
- হে পরন্তপ ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তথা শূদ্রদের কর্ম স্বভাবজাত গুণ-অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। (18.41)
- অন্তঃকরণের সংযম, ইন্দ্রিয়াদি দমন, ধর্মপালনের জন্য কষ্টস্বীকার করা, অন্তরে ও বাইরে শুচিতা(১) রক্ষা করা, অপরের অপরাধ ক্ষমা করা, কায়মনোবাক্যে সরল থাকা, বেদ, শাস্ত্র, ঈশ্বর এবং পরলোকাদিতে শ্রদ্ধা রাখা, বেদাদি গ্রন্থের অধ্যয়ন-অধ্যাপন করা এবং পরমাত্মতত্ত্ব অনুভব করা—এ সবই হল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম। (18.42)
- শৌর্য, তেজ, ধৈর্য, দক্ষতা, যুদ্ধ হতে পলায়ন না করা, দান করা এবং শাসনক্ষমতা—এই সবই হল ক্ষত্রিয়দের স্বভাবজাত কর্ম। (18.43)
- কৃষি, গোপালন, ক্রয়-বিক্রয়রূপ সত্য ব্যবহার (১) —এইগুলি বৈশ্যদের স্বভাবজাত কর্ম এবং সর্ব বর্ণের সেবা করা হল শূদ্রদের স্বাভাবিক কর্ম। (18.44)
- নিজ নিজ স্বভাবজাত কর্মে তৎপর ব্যক্তি ভগবৎ প্রাপ্তিরূপ পরমসিদ্ধি লাভ করেন। নিজ স্বাভাবিক কর্মে তৎপর ব্যক্তি কীরূপে কর্মের দ্বারা পরম সিদ্ধি লাভ করেন, আমার নিকট সেই বিধি শোনো। (18.45)
- যে-পরমেশ্বর হতে সমস্ত প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে এবং যিনি সমস্ত জগতে পরিব্যাপ্ত(১) হয়ে আছেন, সেই পরমেশ্বরকে নিজের স্বাভাবিক কর্মের দ্বারা অর্চনা করে(২) মানুষ পরম সিদ্ধি লাভ করে। (18.46)
- উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত অন্যের ধর্ম হতে গুণরহিত স্বধর্ম শ্রেষ্ঠ ; কারণ স্বভাবনির্দিষ্ট স্বধর্মরূপ কর্মে মানুষের পাপ হয় না। (18.47)
- অতএব, হে কুন্তীপুত্র ! দোষযুক্ত হলেও সহজকর্ম(১) ত্যাগ করা উচিত নয়, কারণ ধূমাবৃত অগ্নির ন্যায় সমস্ত কর্মই কোনো না কোনোভাবে দোষযুক্ত। (18.48)
- নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিং পরমাং সন্ন্যাসেনাধিগচ্ছতি। সর্বত্র অনাসক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন, নিস্পৃহ, জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি সাংখ্যযোগের দ্বারা সেই পরম নৈষ্কর্ম সিদ্ধিলাভ করেন। (18.49)
- যা জ্ঞানযোগের পরনিষ্ঠা, সেই নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি লাভ করে মানুষ যেভাবে ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়, হে কৌন্তেয় ! তুমি সংক্ষেপে তা আমার নিকট শোনো। (18.50)
- বিশুদ্ধ বুদ্ধিযুক্ত, সাত্ত্বিক, মিতভোজী, শব্দাদি বিষয়সমূহ ত্যাগ করে একান্ত শুদ্ধস্থানে বসবাসকারী, সাত্ত্বিক ধৃতির(১) দ্বারা অন্তঃকরণ ও ইন্দ্রিয় সংযম করে কায়মনোবাক্যে সংযমী, রাগ-দ্বেষ সর্বতোভাবে বর্জনপূর্বক দৃঢ় বৈরাগ্য-অবলম্বন করে তথা অহঙ্কার-বল-দর্প-কাম-ক্রোধ এবং পরিগ্রহ ত্যাগ, করে নিরন্তর ধ্যানযোগে নিরত, মমত্বশূন্য, প্রশান্তচিত্ত পুরুষ সচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্মে অভিন্নরূপে অবস্থান করতে সমর্থ হন। (18.51, 18.52 & 18.53)
- স্থিত প্রসন্নচিত্ত যোগী কোনো কিছুর জন্য শোক করেন না বা কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষাও করেন না ; এইরূপ সর্বভূতে সমভাবযুক্ত(১) যোগী আমার পরাভক্তি লাভ করেন । (18.54)
- সেই পরাভক্তির দ্বারা তিনি পরমাত্মরূপী আমাকে, আমি কে এবং কতটা, তা ঠিক ঠিক তত্ত্বতঃ জানতে পারেন এবং সেই ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বতঃ জেনে অচিরাৎ আমার মধ্যে প্রবেশ করেন। (18.55)
- মৎপরায়ণ কর্মযোগী সকল কর্ম সর্বদা করতে থেকেও আমার কৃপায় সনাতন অবিনাশী পরমপদ প্রাপ্ত হন। (18.56)
- সমস্ত কর্ম মনে মনে আমাকে সমর্পণ করে সমবুদ্ধিরূপ যোগ অবলম্বন করে, মৎপরায়ণ হয়ে নিরন্তর আমাতে চিত্ত রাখো। (18.57)
- উপরিউক্ত প্রকারে মদ্গত চিত্ত হয়ে তুমি আমার কৃপায় সমস্ত সঙ্কট অনায়াসে অতিক্রম করবে, আর যদি অহংকারবশতঃ আমার কথা না শোনো, তবে বিনষ্ট হবে অর্থাৎ পরমার্থ হতে ভ্রষ্ট হবে। (18.58)
- তুমি অহঙ্কারবশতঃ মনে করছো যে, যুদ্ধ করবে না কিন্তু তোমার এই সিদ্ধান্ত মিথ্যা ; কারণ তোমার স্বভাবই জোর করে তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করাবে। (18.59)
- হে কুন্তীপুত্র ! যে-কৰ্ম তুমি মোহবশতঃ করতে চাইছ না, সেই কর্মই পূর্বকৃত স্বাভাবিক কর্মে আবদ্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে করবে। (18.60)
- হে অর্জুন ! শরীররূপ যন্ত্রে আরূঢ় সকল প্রাণীকে অন্তর্যামী পরমেশ্বর তাদের কর্ম-অনুসারে নিজ মায়ার দ্বারা চালিত করে সকল প্রাণীর হৃদয়ে স্থিত রয়েছেন। (18.61)
- হে ভারত ! তুমি সর্বতোভাবে সেই পরমেশ্বরেরই শরণাগত(?) হও। তাঁর কৃপাতেই তুমি পরমশান্তি এবং সনাতন পরমধাম প্রাপ্ত হবে। (18.62)
- এইভাবে গুহা হতে অতি গুহ্য জ্ঞান আমি তোমাকে বললাম। এখন তুমি এই রহস্যময় জ্ঞানকে ভালোভাবে বিচার করে যেমন চাও, তেমন করো। (18.63)
- সর্বাপেক্ষা গোপনীয় হতেও অতিশয় গোপনীয় আমার পরম রহস্যময় কথা আবার শোনো। তুমি আামার অত্যন্ত প্রিয়, তাই এই পরম হিতকারক বাক্য তোমাকে পুনরায় বলব। (18.64)
- হে অর্জুন ! তুমি আমার প্রতি মনযুক্ত হও, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা করো এবং আমাকে নমস্কার “করো। আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি যে এরূপ করলে তুমি আমাকেই প্রাপ্ত হবে ; কারণ তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। (18.65)
- করে তুমি সর্বশক্তিমান, সর্বাধার পরমেশ্বররূপ একমাত্র আমার শরণ(১) গ্রহণ করো। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ হতে মুক্ত করব, তুমি শোক করো না। (18.66)
- এই গীতারূপ রহস্যময় উপদেশ কখনও তপস্যাহীন, ভক্তিহীন, এবং শুনতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের বলবে না, আর যারা আমার প্রতি দোষদৃষ্টি রাখে তাদের তো কখনও বলবে না। (18.67)
- যিনি আমার প্রতি পরম ভক্তিপূর্বক এই পরম গুহা গীতাশাস্ত্র আমার ভক্তগণের নিকট বলবেন, তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হবেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই। (18.68)
- মানুষের মধ্যে তাঁর অপেক্ষা প্রিয় কর্মকারী আমার আর কেউ নেই এবং পৃথিবীতে তাঁর অপেক্ষা আমার প্রিয় ভবিষ্যতে কেউ হবেও না। (18.69)
- যে-ব্যক্তি আমাদের উভয়ের এই ধর্মময় সংবাদরূপ গীতাশাস্ত্র পাঠ করবেন, তাঁর সেই জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হব—এই আমার মত। (18.70)
- যিনি শ্রদ্ধাসহকারে এবং দোষদৃষ্টিরহিত হয়ে এই গীতাশাস্ত্র শ্রবণ করেন, তিনিও পাপমুক্ত হয়ে উত্তম . কর্মকারীদের শ্রেষ্ঠ লোক প্রাপ্ত হন। (18.71)
- হে পার্থ ! তুমি কি এই গীতা শাস্ত্র একাগ্র মনে শুনেছ ? হে ধনঞ্জয় ! তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ কি নষ্ট হয়েছে ? (18.72)
- অর্জুন বললেন—হে অচ্যুত ! আপনার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতি ফিরে পেয়েছি, এখন আমি নিঃসংশয় হয়েছি, অতএব আমি আপনার আদেশ পালন করব। (18.73)
- সঞ্জয় বললেন—এইরূপে আমি ভগবান শ্রীবাসুদেব এবং অর্জুনের মধ্যে এই অদ্ভুত, রহস্যময় ও রোমাঞ্চকর কথোপকথন শুনেছি। (18.74)
- শ্রীবেদব্যাসের কৃপায় দিব্যদৃষ্টি লাভ করে এই পরম গুহ্য যোগের কথা স্বয়ং যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলছিলেন তখন আমি তা প্রত্যক্ষভাবে শুনেছি। (18.75)
- হে রাজন্ ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের এই রহস্যময়, কল্যাণকারী, অদ্ভুত কথোপকথন পুনঃ পুনঃ স্মরণ করে আমি বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছি। (18.76)
- হে রাজন্ ! শ্রীহরির সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপও পুনঃ পুনঃ স্মরণ করে আমার চিত্তে মহাবিস্ময় হচ্ছে এবং আমি বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছি। (18.77)
- হে রাজন্ ! যেখানে যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং গাণ্ডীব ধনুর্ধারী অর্জুন রয়েছেন সেইখানেই শ্ৰী, বিজয়, বিভূতি ও অচল নীতি বিদ্যমান—এই আমার মত। (18.78)