সঞ্জয় উবাচ
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমস্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসুদনঃ।।
সঞ্জয় বললেন-ঐ প্রকার করুণার্দ্র এবং অশ্রুপূর্ণ আকুললোচন বিষণ্ণ অর্জুনকে তখন ভগবান এই কথা বললেন।
Commentary:
সঞ্জয় এবার ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, অর্জুনের চোখে জল, দৃশ্যগুলি ঝাপসা হয়ে গেছে, খুব করুণ অবস্থা। যুদ্ধারম্ভের পূর্ব মুহূর্তে অর্জুন একেবারে ভেঙে পড়েছেন। শোকাতুর অর্জুনকে তখন শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে শুরু করছেন। আগের অধ্যায়ের নামের সাথে ‘বিষাদ’ শব্দ ছিল, আর দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে ‘বিষাদ’ শব্দটা পাল্টে গিয়ে এবার কৃপয়া শব্দটা এসেছে।
শুধু বিষাদেই না, যে কোন ইমোশান যদি মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তা যে কোন ইমোশান হোক না কেন, ভাল হোক, মন্দ হোক, হাসিখুশীর হোক, কান্নাকাটির হোক, ক্রোধের হোক, তখন আমরা সত্যকে দেখতে পাই না, সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়।
আমাদের একটা ধারণা যে, আমাদের যদি কোন motive না থাকে, ফল পাওয়ার ইচ্ছা যদি না থাকে, তাহলে মানুষ কি করে কাজ করবে? এটাকেই স্বামীজী বলছেন, Unselfishness is more paying, only people have not the patience to practice it.। ইমোশানকে সরিয়ে একবার কাজ করে দেখুন, দেখবেন কাজ অনেক ভাল হবে। বাচ্চারা বাড়িতে সেই ভাবে ট্রেনিং পায় না, যার জন্য স্কুল, কলেজের এত গুরুত্ব। স্কুলে ড্রীল করাচ্ছে, শিক্ষকরা একটা কড়া অনুশাসনে রাখছে, এর একটাই উদ্দেশ্য, ওর ইমোশানসকে রেগুলেট করা।
আমরা সবাই ইমোশানসের মধ্যে ভাসছি, এই হাসছি, এই কাঁদছি, এই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছি, এর ফলস্বরূপ আমরা জিনিসটাকে সঠিক ভাবে দেখতে পাই না। আমাদের সবার জীবনের একেবারে শেষ ইমোশান হল আমার আমিত্ব। আমিত্ব আছে বলেই এত কিছু হচ্ছে। আর এই আমিত্ব আছে বলেই ঈশ্বর দর্শন হয় না, আত্মজ্ঞান হয় না। এই আমিত্বকে কিন্তু আমরা কেউই ছাড়তে পারব না। তোতাপুরির তত্ত্বাবধানে ঠাকুরও অদ্বৈত সাধনার সময় আমিত্বকে ছাড়তে পারছেন না। দক্ষিণেশ্বরে নরেনকে যখন ঠাকুর একটু ছুঁয়ে দিলেন, তখন নরেন্দ্রনাথ চেঁচিয়ে বলছেন, ‘আপনি একি করলেন, আমার যে বাবা আছে, মা আছে’। এই আমিত্ব কিছুতেই যেতে চায় না। আমরা মনে করতে পারি ওনারা কত বিরাট মাপের লোক, আমরা তো অতি সাধারণ; কিন্তু সাধারণ আর অসাধারণ যাই হয়ে থাকুন, আমিত্ব সবারই থাকবে। শ্লোক যখন আসবে তখন এর উপর আমরা যে আলোচনা করব, সেটাও জানার জন্য, জ্ঞানলাভের জন্য। কিন্তু সাধারণ জিনিসগুলো যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সব সময় লাগছে, সেগুলোকে আমাদের বুঝতে হবে। সেখানে আমিত্ব থেকে সব ইমোশানগুলি ছড়াতে থাকে।
পতঞ্জলি যোগসূত্রে পাঁচটা শব্দ বলছেন অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ আর অভিনিবেশ। এই পাঁচটি মিলিয়েই সব কিছু হয়। অভিনিবেশ শব্দের অর্থ বেঁচে থাকার ইচ্ছা। আমাদের যাবতীয় কর্ম, উদ্যোগ, চেষ্টা, সবের পিছনে আছে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। অর্থোপার্জন করছি, বেঁচে থাকার ইচ্ছা, ঘরবাড়ি করছি, গাড়ি করছি, বেঁচে থাকার ইচ্ছা। অভিনিবেশের উপরে আছে রাগ আর দ্বেষ, আমরা কিছু জিনিসকে পছন্দ করি, কিছু জিনিসকে অপছন্দ করি। তারও পিছনে রয়েছে অস্মিতা, এটাই আমিত্ব, যেখানে পুরুষ আর প্রকৃতির যোগ হয়। এই সব কিছুর পিছনে রয়েছে অবিদ্যা। অবিদ্যা মানে, আমি আমার স্বরূপ ভুলে গেছি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের একটা দুটো শ্লোক এই অবিদ্যাকে কেন্দ্র করেই চলবে।
স্বরূপ ভুলে যাওয়া মানেই, আমি তোমার সঙ্গে জুড়ে গেলাম। যখনই আমি তোমার সাথে জুড়ে গেলাম, তখন আমি নিজেকে ছোট করে নিলাম। পুরুষ অনন্ত, আর প্রকৃতি সীমিত। অনন্ত সীমিতের সাথে জুড়ে দেয়, তারপর তার সাথে থাকতে থাকতে এক অপরের ভাবকে আপন করে নেয়। কারুর সাথে গভীর বন্ধুত্ব হলে, যেমন স্বামী-স্ত্রীর হয়; লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কিছু দিন পর স্বামী যেভাবে কথা বলে, স্ত্রীও সেই ভাবে কথা বলতে শুরু করে। স্ত্রী যেভাবে হাঁটচলা করে, স্বামীর হাঁটাচলা সেই ভাবে হতে থাকে। ধীরে ধীরে দুজনের হাঁটাচলা, কথা বলা, হাত পা নাড়া, চোখের চাহনি, এক অপরের মত হতে শুরু করে।
পুরুষ ও প্রকৃতির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়। দুজনের যখন মিলন হয়, তখন পুরুষ প্রকৃতির স্বভাব পেয়ে যায়, প্রকৃতি পুরুষের স্বভাব পেয়ে যায়। পুরুষ বলতে এখানে চৈতন্য, প্রকৃতি বলতে জড়। জড় নিজেকে চেতন মনে করে, বুদ্ধি নিজেকে চেতন মনে করে, আর আত্মা নিজেকে সীমিত মনে করে। আমার খুব প্রিয়জন যদি কারুর পাল্লায় পড়ে যায়, আর যদি দেখি আমার প্রিয়জনকে অপমানিত করতে শুরু করেছে, আমার আপনজন তখন ছোট হতে থাকে। তাকে আমরা কত বোঝাই, তুমি ওর পাল্লায় পড়ে আর নিজেকে কত ছোট করবে! ঠাকুর বলছেন, যারা চাকরি করে, তাদের ওখানে কাজ করতে করতে তাদের আত্মসম্মান হারিয়ে যায়। ছোট হতে হতে আমরা নিজের মানমর্যাদা সব হারিয়ে ফেলে আমার আসল সত্তাকেই ভুলে যাই, কারণ আমি যে তার সাথে নিজেকে জুড়ে রেখেছি। একবার শুধু বলে দেওয়া, সম্পর্কটা আমি কেটে দিলাম, তুমি এবার বিদায় হও। বলা যায় না, খুব কঠিন, তাকে ছেড়ে যেতে যে কষ্ট হবে। কিন্তু একবার কেটে দিলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি আবার নিজের মত স্বাধীন হয়ে যাবে।
পুরুষ আর প্রকৃতির সম্পর্ক ঠিক এই রকম, প্রকৃতি সব সময় পুরুষকে ছোট করে দাবিয়ে রাখতে চাইবে। পুরুষ ছোট হতে হতে একটা সময় বলতে শুরু করে, কৃপা করুন আমাকে। সবার কাছে গিয়ে কৃপা ভিক্ষা করে, মহারাজ কৃপা করুন, জেলাশাসককে বলবে, কৃপা করুন, পুলিশকে গিয়ে বলবে কৃপা করুন। কৃপা করুন মানে, আমি ছোট আপনি বড়, আপনি আমার উপর কৃপা করুন। আমাদের একবারও কিন্তু মনে হয় না যে, তিনি যে পোস্টে আছেন, যেই হয়ে থাকুন, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকুন, আত্মা রূপে আমি তার থেকে অনেক বড়। কিন্তু আমি নিজেকে সাধারণ মনে করছি বলে আমি তাঁর কাছে সাধারণ। মাটির ইঁদুর আর মাটির হাতি, ইঁদুর রূপে সে হাতির কাছে কিছুই না। কিন্তু মাটি রূপে সে হাতি থেকে বিরাট। আপনি হয়ত বলতে পারেন, মাটি রূপে হাতিটাও তো বিরাট। ঠিক, কিন্তু তার কাছে তো আপনি হাতি রূপে যাচ্ছেন না, সমস্যা তো আপনিই তৈরী করছেন। তখনই আমরা আমাদের স্বভাববশতঃ বলি, কৃপা করুন। যে কাতর হয়ে কাকুতি মিনতি করছে, বুঝতে হবে সে তার স্বরূপ ভুল গেছে। স্বরূপ ভুলে যাওয়া মানে, আমি কে, আমার আসল পরিচয় কি, সেটাকে ভুলে যাওয়া। যতক্ষণ না তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, তুমি কে, তোমার কত ক্ষমতা আছে, ততক্ষণ তার দুঃখের আর শেষ নেই, ততদিন সে ছোট থেকে ছোট হয়েই সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবে, ওখান থেকে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
সঞ্জয় বলছেন, বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ, অর্জুনের বিষন্নতা, চোখে জল দেখে শ্রীকৃষ্ণ অবাক হয়ে গেছেন। যদিও এখানে অবাক শব্দ নেই। অবাক হয়ে অর্জুনকে তখন শ্রীকৃষ্ণ বলতে শুরু করলেন।