তান্ হোবাচৈতাবদেবাহমেতৎ পরং ব্রহ্ম বেদ। নাতঃ পরমস্তীতি॥৭
অন্বয়: তান্ উবাচ হ [পিপ্পলাদ] (তাদের [অর্থাৎ শিষ্যদের] বললেন); অহম্ (আমি); এতৎ পরং ব্রহ্ম (এই পরব্রহ্ম); এতাবৎ এব (এই পর্যন্ত); বেদ (জানি); অতঃ পরম্ (এর চেয়ে উচ্চতর); ন অস্তি (আর নাই)।
সরলার্থ: পিপ্পলাদ শিষ্যদের বললেন : ‘পরব্রহ্মকে আমি এই পর্যন্তই জানি। তাঁর সম্পর্কে জানবার আর কিছু নেই।’
ব্যাখ্যা: এই হল গুরুর শেষ কথা। আমাদের মনে পড়বে, একদল তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী ঋষি পিপ্পলাদের কাছে এসেছিলেন। এই সকল তরুণ শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও পরম সত্য সম্পর্কে তাঁদের কোন প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিল না। শাস্ত্রের শব্দার্থ তাঁরা বুঝেছিলেন কিন্তু মর্মার্থকে তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। তাই এইসব শিক্ষার্থীরা পিপ্পলাদকে বলেছিলেন : ‘সবকিছু (শাস্ত্র) পড়েও আমাদের মনে হচ্ছে আমরা কিছুই জানি না। অনুগ্রহ করে আপনি আমাদের শিক্ষা দিন। আমরা ব্রহ্মকে জানতে চাই।’
তখন পিপ্পলাদ সবকিছু ব্যাখ্যা করলেন। সবশেষে তিনি বললেন : ‘এই হল পরমতত্ত্ব। এর অতিরিক্ত আমি আর কিছুই জানি না এবং আমি মনে করি এর বাইরে আর কিছুই নেই।’ মুণ্ডক উপনিষদে আছে, যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি সব কিছু জানেন। আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, কিন্তু সে জ্ঞানই চূড়ান্ত নয়। যতক্ষণ ব্রহ্মকে জানতে না পারি ততক্ষণ আমরা কিছু জানি না। আমাদের মধ্যে তখন শূন্যতার বোধ জন্মায়। ঋষি পিপ্পলাদ বললেন: ‘পরব্রহ্ম ছাড়া আর জানবার কিছুই নেই। আমি তোমাদেরকে এই পরব্রহ্মের কথাই বলেছি। এছাড়া পরব্রহ্ম সম্পর্কে আর কিছু বলবার নেই।’
সুতরাং এই সিদ্ধান্ত। পরব্রহ্মকে জানাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। তুমি হয়তো একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং শাস্ত্রে তোমার অগাধ পাণ্ডিত্যও আছে। কিন্তু পাণ্ডিত্য এবং ব্রহ্মজ্ঞান এক নয়। শাস্ত্রনিহিত সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে না পারলে তা হবে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ মাত্র। আত্মজ্ঞান লাভ হলে মানুষের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তিনি এক অন্য মানুষে পরিণত হন। এটাই জ্ঞানের পরীক্ষা। আমরা শাস্ত্র নিয়ে নানা আলোচনা করতে পারি, এমনকি তা থেকে উদ্ধৃতিও দিতে পারি। কিন্তু আমরা যদি নীচ, স্বার্থপর ও অসৎ হই তবে এই সকল আলোচনা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনই আমাদের বলে দেয় তিনি পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর জীবন আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁর চরিত্র আমাদের আকৃষ্ট করে। তাঁকে ভগবান বলে মনে হয়। তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন কিন্তু আগুনকে কি কখনও লুকিয়ে রাখা যায়? শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে পারেন না। আমরা তাঁকে দেখে আনন্দ পাই। কারণ তিনি যে আনন্দস্বরূপ। এই লক্ষণ দেখেই ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তিকে চেনা যায়।