স প্রাণমসৃজত প্ৰাণাচ্ছ্রদ্ধাং খং বায়ুর্জ্যোতিরাপঃ পৃথিবীন্দ্রিয়ং
মনঃ। অন্নমন্নাদ্বীর্যং তপো মন্ত্রাঃ কর্ম লোকা লোকেষু চ
নাম চ॥৪
অন্বয়: সঃ (তিনি অর্থাৎ ব্রহ্ম); প্রাণম্ (হিরণ্যগর্ভ); অসৃজত (সৃষ্টি করলেন); প্রাণাৎ শ্রদ্ধাম্ (প্রাণ থেকে শ্রদ্ধা [অর্থাৎ শাস্ত্রাদিতে শ্রদ্ধা]); খম্ ([শ্রদ্ধা থেকে] আকাশ); বায়ুঃ ([আকাশ থেকে] বাতাস); জ্যোতিঃ (অগ্নি); আপঃ (জল); পৃথিবী (পৃথিবী); ইন্দ্রিয়ম্ (ইন্দ্রিয়); মনঃ (মন); অন্নম্ (খাদ্য); অন্নাৎ (খাদ্য থেকে); বীর্যম্ (বীর্য); তপঃ (তপস্যা); মন্ত্রাঃ (বেদসমূহ); কর্ম (যজ্ঞকর্ম); লোকাঃ (কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত লোকসমূহ); লোকেষু চ নাম চ (এবং সেই লোকসমূহে বিভিন্ন নামরূপ)।
সরলার্থ: সেই পুরুষ (সগুণ ব্রহ্ম) হিরণ্যগর্ভকে (প্রাণাত্মা) সৃষ্টি করলেন। হিরণ্যগর্ভ বা প্রাণ থেকে সৃষ্টি হল শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা থেকে আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী এবং ইন্দ্রিয় এল (সৃষ্টি হল)। তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন মন এবং অন্ন। অন্ন থেকে ক্রমে বীর্য, বেদসমূহ, কর্ম (যাগযজ্ঞ), স্বর্গ এবং অন্যান্য লোক, এবং লোকসমূহে বিভিন্ন নাম বা পদসমূহ এল (সৃষ্টি হল)।
ব্যাখ্যা: মৃত্যুর সময় আমাদের দেহ ছেড়ে কে বেরিয়ে যান? উত্তরটি হল প্রাণ অর্থাৎ প্রাণশক্তি। এই প্রাণকে হিরণ্যগর্ভও বলা হয়। হিরণ্যগর্ভই হল ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। এঁর অপর নাম হল সূত্ৰাত্মা। সূত্র অর্থ সুতো। বিভিন্ন প্রাণীকে ইনি একই সুতোয় গেঁথে রাখেন। কোন মানুষ হয়তো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, তার ইন্দ্রিয়সকলও হয়তো অক্ষত। কিন্তু মৃত্যুর পর তার আর কোন ইন্দ্রিয়ই কাজ করতে পারে না। কারণ প্রাণ দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।
উপনিষদ বলেন, শ্রদ্ধা আসে এই প্রাণ থেকেই। শ্রদ্ধা শব্দটির অর্থ হল বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস বা আত্মশ্রদ্ধা। কিন্তু এর অপর অর্থ হল আস্তিক বুদ্ধি, গুরুবাক্যে ও শাস্ত্রে বিশ্বাস। শ্রদ্ধা শব্দের দ্বারা সৎ ইচ্ছাকেও বোঝানো হয়। শ্রদ্ধা যেন একরকমের সংগ্রাম, ভাল থেকে ভালতর, ভালতম হওয়ার সংগ্রাম। এই শ্রদ্ধা শুধুমাত্র মানুষেরই থাকে।
তারপর শ্রদ্ধাসম্পন্ন প্রাণশক্তি থেকে একে একে পাঁচটি উপাদান প্রকাশ পায়। প্রথম হল ‘খম্’—যা আকাশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি উপাদানেরই নির্দিষ্ট গুণ আছে যেমন আকাশের গুণ হল শব্দ। আকাশ থেকে আসে বাতাস। বায়ুর দুটি গুণ। এর প্রধান গুণ হল স্পর্শ। কিন্তু আকাশের গুণ শব্দও এর সাথে জড়িত। এর পরের উপাদান হল জ্যোতি যাকে অগ্নিও বলা হয়। এর নিজস্ব গুণ হল রূপ কিন্তু শব্দ ও স্পর্শ গুণও অগ্নির সাথে যুক্ত। বায়ুকে দেখা যায় না কিন্তু এর শব্দ শোনা যায় এবং একে অনুভব করা যায়। আবার আগুনকে দেখা যায়, শোনা যায় এবং স্পর্শ করা যায়।
জল আসে আগুনের কাছ থেকে। জলের নিজস্ব গুণ হল রস (স্বাদ)। তবে শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিন গুণই এর মধ্যে রয়েছে। তারপর জল থেকে আসে এই পৃথিবী বা ক্ষিতি। পৃথিবীর মধ্যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এ সকল গুণই রয়েছে। গন্ধ হল পৃথিবীর নিজস্ব গুণ। কাজেই এই প্রকাশ সূক্ষ্ম থেকে ধীরে ধীরে স্থূল হয়।
কর্ম ছাড়া জীব এ সংসারে থাকতে পারে না। তাই উপাদান থেকে ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়—প্রথমে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পরে কর্মেন্দ্রিয়। পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় হল—কান (শ্রোত্র), চোখ (চক্ষু), নাসিকা (ঘ্রাণ), জিভ (জিহ্বা), ত্বক (স্পর্শেন্দ্রিয়)। এগুলো আবার উপাদানের বিভিন্ন গুণ যথা—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ-এর অনুরূপ। জ্ঞানেন্দ্রিয় সকল খুবই সূক্ষ্ম। তারপরে আসে আমাদের কর্মেন্দ্রিয় যা অপেক্ষাকৃত স্থূল। কর্মেন্দ্রিয়গুলি হল বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।
এখন প্রশ্ন হল, এই ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে কে? মনঃ অর্থাৎ মন। এই মনকে অন্তঃকরণও বলা হয়ে থাকে। মনের চারটি দিক আছে। মন শব্দটি প্রথম দিককে অর্থাৎ মনের বিষয়কে প্রকাশ করে। এই দিকটি যেন সবসময়ই দুলছে। যেমন—আমি এটা করব না ওটা করব? বুদ্ধিই সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই হল বোধশক্তি। ‘আমি কি করব, আমার কি করা উচিত’—বুদ্ধি তা স্থির করে। ‘চিত্ত’ হল মনের আর একটি দিক যাতে অনুভূতি, আবেগ ও স্মৃতি জমা থাকে। তারপর হচ্ছে অহঙ্কার অর্থাৎ আমিত্ব বোধ। এই আমিত্ব বোধ থেকেই জীবের উৎপত্তি। ব্যক্তি মাত্রেই এই অহংবোধ থাকে।
পরবর্তী প্রকাশ হল অন্ন বা খাদ্য। ব্যক্তিমাত্রেরই জীবনধারণের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য থেকেই আসে বীর্য ও তেজ। বীর্য থেকেই আসে তপঃ অর্থাৎ কৃচ্ছ্রতা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা ক্রমশ বুঝতে পারি এ জগতে কিছু লাভ করতে গেলে শক্তি, কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মসংযমের প্রয়োজন। এর জন্য একজন পথপ্রদর্শক প্রয়োজন, যিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা এই সমাজের জন্য কিছু করতে চাই এবং আমাদের মধ্যে হয়তো সে ক্ষমতাও আছে। তা সত্ত্বেও একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন যিনি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। তারপর আসে মন্ত্র। মন্ত্র বলতে এখানে বেদকে বোঝানো হয়েছে। শাস্ত্রের নির্দেশমতো আমাদের চলা উচিত।
মন্ত্র থেকেই কর্মের উৎপত্তি। বেদের বিধান অনুসারে আমরা যাগযজ্ঞ এবং অন্যান্য কার্যকলাপ করতে পারি। এর ফলস্বরূপ আমরা বিভিন্ন লোক প্রাপ্ত হই। লোক অর্থাৎ জগৎ। তপস্যা, আত্মসংযম, শাস্ত্রপাঠ এবং যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা আমরা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারি। আমরা ভাল আছি কিন্তু আরো ভাল হতে পারি। আবার লোক শব্দের দ্বারা আমাদের অবস্থা বোঝানো হয়ে থাকে। যদি আমি সৎ, সাধু, দয়ালু ও নিঃস্বার্থপর হই এবং সৎসঙ্গে জীবন কাটাই তবে তা হবে স্বর্গবাসের সমান। ঠিক সেরকমভাবে আমি যদি বাজে কাজ করি, অসৎসঙ্গে দিন কাটাই তাহলে সবসময়ই আমাকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে এবং অসুখী হব। একেই নরকবাস বলা হয়ে থাকে। লোক বলতে এখানে চৈতন্যের স্তর, অস্তিত্বের স্তরকে বোঝানো হয়েছে। তারপর এই জগৎ থেকেই নামের সৃষ্টি হয়েছে। নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমরা একে অপরের থেকে আলাদা অর্থাৎ স্বতন্ত্র।
কাজেই নির্গুণ, নিরাকার পুরুষ থেকেই এই ষোলকলা এসেছে। তারা পুরুষ থেকে পৃথক নয়। পুরুষ এইভাবেই নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন।