অথ হৈনং সুকেশা ভারদ্বাজঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্ হিরণ্যনাভঃ কৌসল্যো
রাজপুত্রো মামুপেত্যৈতং প্রশ্নমপৃচ্ছত। ষোড়শকলং ভারদ্বাজ পুরুষং
বেত্থ। তমহং কুমারমব্রুবং নাহমিমং বেদ। যদ্যহমিমমবেদিষং কথং তে
নাবক্ষ্যমিতি। সমূলো বা এষ পরিশুষ্যতি যোঽনৃতমভিবদতি
তস্মন্নার্হাম্যনৃতং বক্তুম্। স তূষ্ণীং রথমারুহ্য প্রবব্রাজ। তং ত্বা পৃচ্ছামি
ক্বাসৌ পুরুষ ইতি॥১
অন্বয়: অথ হ (তারপর); এনম্ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে]); ভারদ্বাজঃ সুকেশা (ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা); পপ্ৰচ্ছ (জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্, (ভগবান); কৌসল্যঃ রাজপুত্রঃ হিরণ্যনাভঃ (কোসলদেশীয় রাজপুত্র হিরণ্যনাভ); মাম্ উপেত্য এতং প্রশ্নম্ অপৃচ্ছত (আমার কাছে এসে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন); ভারদ্বাজ (হে ভরদ্বাজপুত্র); ষোড়শকলং পুরুষং বেত্থ (ষোড়শকলা বিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?); অহং তং কুমারম্ অব্রুবম্ (আমি রাজকুমারকে বলেছিলাম); ন অহম্ ইমং বেদ (আমি এই পুরুষকে জানি না); যদি অহম্ ইমম্ অবেদিষম্ (যদি আমি তাঁকে জানি); কথং তে ন অবক্ষ্যম্ (তবে কেন আপনাকে তা বলব না); যঃ অনৃতম্ অভিবদতি (যিনি মিথ্যা বলেন); এষঃ সমূলঃ পরিশুষ্যতি (তিনি সমূলে শুষ্ক [অর্থাৎ বিনষ্ট] হন); তস্মাৎ (সেই কারণে); অনৃতং বক্তুং ন অর্হামি (আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না); সঃ (তিনি, রাজপুত্র); তূষ্ণীম্ (শান্তভাবে); রথম্ আরুহ্য প্রবব্রাজ (রথে চড়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন); তং ত্বা পৃচ্ছামি (এখন আমি আপনাকে সেই [পুরুষ] বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি); ক্ক অসৌ পুরুষঃ (কোথায় সেই পুরুষ)?
সরলার্থ: তারপর ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা পিপ্পলাদকে বললেন: ভগবান, কোসলদেশীয় রাজপুত্র হিরণ্যনাভ একসময়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে ভরদ্বাজপুত্র, ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?’ আমি সেই কুমারকে বললাম, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। যদি আমি জানতাম তবে আপনাকে বলব না কেন?’ যে লোক মিথ্যা কথা বলে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। অতএব আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না।’ এই কথা শুনে তিনি নীরবে রথে চড়ে চলে গেলেন। এখন আমি আপনাকে সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছি, ‘সেই পুরুষ কোথায়?’
ব্যাখ্যা: ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা এই ষষ্ঠ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি পিপ্পলাদকে বললেন, একসময়ে কেমন করে কোসলদেশীয় এক রাজপুত্র তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষকে আপনি জানেন কি?’ অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সেই পুরুষকে তিনি জানেন কিনা। ষোল আনায় যেমন এক টাকা তেমনি তিনি ষোলকলাবিশিষ্ট এক পূর্ণসত্তা।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে সুকেশা বিদ্বান ব্যক্তি বলেই রাজপুত্র তাঁর কাছে এসেছিলেন। রাজপুত্র তো তাঁকে ডেকে পাঠাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। রাজপুত্র অত্যন্ত বিনীতভাবে সুকেশার নিকট উপস্থিত হলেন। এভাবেই সত্যলাভে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী গুরুর কাছে যান। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে গুরুকে প্রশ্ন করেন।
সুকেশার মধ্যে কোন কপটতা ছিল না। তাই তিনি খোলাখুলি বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন না। রাজপুত্র শিষ্য হবার পক্ষে অনুপযুক্ত তাই সুকেশা জেনেও না জানার ভান করছেন—পাছে রাজপুত্র এমন কথা মনে করেন তাই সুকেশা বলছেন, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা থাকলে তোমায় বলব না কেন?’
শিষ্য অনেকসময়ই গুরুকে প্রশ্ন করে থাকেন। প্রশ্নের ধরন দেখে গুরু বুঝে নেন শিষ্য কি প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করছেন, না তিনি প্রকৃতই জিজ্ঞাসু। শিশুরাও কখনও কখনও প্রশ্ন করে থাকে। প্রশ্ন শুনে বেশ বোঝা যায় তারা এ ব্যাপারে মনোযোগী নয় এবং এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। তাই সে প্রশ্নের উত্তর শুনলেও তারা কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
কিন্তু শিষ্য যদি আন্তরিকতার সাথে গুরুকে প্রশ্ন করেন এবং গুরু যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে না চান তাহলে তিনি খুব অন্যায় করবেন। উপনিষদ বলেন, এরকম অবস্থায় তাঁর সকল জ্ঞান সমূলে বিনষ্ট হয়। শুকিয়ে গেলে গাছের যেরকম অবস্থা হয়, এও যেন ঠিক তাই। এমনও অনেক গুরু আছেন যিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান শিষ্যকে দান করেন না অর্থাৎ জেনেও না জানার ভান করে মিথ্যা কথা বলেন। তখন তাঁর জীবনে অভিশাপ নেমে আসে। তাঁর সমস্ত জ্ঞান লোপ পায়।
সুকেশা দেখলেন রাজপুত্র নীরবে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। রাজকুমারের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার জন্য সুকেশার ভীষণ খারাপ লাগল। তখন থেকেই তিনি সেই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে সচেষ্ট হলেন। আচার্য শঙ্কর বলছেন, জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তির মনে হয় তাঁর হৃদয়ে যেন তীর গেঁথে আছে। ব্যথায় তিনি ছটফট করছেন। বেদান্তসারে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির মাথায় আগুন জ্বললে তিনি যেমন জলের জন্য ছটফট করতে থাকেন শিষ্যের আত্মজ্ঞান লাভের ব্যাকুলতাও ঠিক সেইরকম, তাঁকে অবশ্যই এই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সেজন্য শিষ্য আদর্শ গুরুর খোঁজ করবেন যিনি পথ দেখাবেন।
এই ষষ্ঠ প্রশ্নটি আত্মার সম্বন্ধে করা হয়েছে, যে আত্মা নিজেকে জগৎরূপে প্রকাশ করেছেন। আত্মাকে এখানে ‘পুরুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ইনিই সকলের অন্তরস্থ আত্মা। এখানে এই আত্মাকে ষোলকলাবিশিষ্ট পুরুষ বলা হয়েছে। ষোলকলা বলতে সম্ভাব্য সকল বৈশিষ্ট্য বা উপাধিকে বোঝায়। এই সকল উপাধির নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই, এরা আত্মার ওপর আরোপিত মাত্র। এ সকল উপাধি অনিত্য।
শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন সমগ্র বিশ্ব (সমস্তং জগৎ) এই কার্যকারণের যোগবিয়োগ বা তার পরিণতি ছাড়া আর কিছুই না। সুষুপ্তিতে (স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রায়) আমরা কোথায় যাই? জাগ্রত অবস্থায় আমরা চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন। স্বপ্নাবস্থায় আমরা বিছানায় শুয়ে থাকলেও আমাদের মন কিন্তু পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় দেহ, মন কোনটিই কাজ করে না। মনে হয় আমরা যেন মৃত। সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জাগ্রত হই তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে আমাদের একটু সময় লাগে। ‘এটি সকাল না সন্ধ্যা? আমি কোথায় আছি? আমার কি হয়েছিল?’—ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তখন আমাদের মনে এসে ভীড় করে।
আচার্য শঙ্করের মতে, সবকিছুই তার উৎসে ফিরে যায়। সেই উৎসটি তাহলে কি? পরমাত্মা। পরমাত্মা চৈতন্য ও জ্ঞানস্বরূপ। আমরা যখন জেগে থাকি তখন পরমাত্মা মন ও ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। তখনই সেই আত্মা জগতের সংস্পর্শে আসেন। আমরা কোন কিছু দেখি কিভাবে? এই চোখ কিছুই না, এমনকি মনও কোন কাজ করে না। আত্মা আছেন বলেই আমরা দেখতে পাই। আত্মা মনের মধ্য দিয়ে কাজ করে থাকেন এবং মন কাজ করে চোখের মধ্য দিয়ে। পরমাত্মা তখনই সবকিছু দেখেন।
শঙ্করাচার্য আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পরমাত্মা সবকিছুর উৎসই শুধু নন, সবকিছুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। পরমাত্মা নিজেকে হিরণ্যগর্ভ (সমষ্টি মন) এবং বিরাটরূপে (সমষ্টি দেহ) ব্যক্ত করেন। পরমাত্মা থেকেই সব কিছু এসেছে আবার পরমাত্মাতেই সবকিছু ফিরে যায়। কোন কিছুর আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।
জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থায় আমরা অনেক কিছু দেখি ও অনুভব করে থাকি। এই সবকিছুর আশ্রয় হল পরমাত্মা। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা কিছু দেখি না বা অনুভব করতে পারি না। সবকিছু তখন কোথায় যায়? সাময়িকভাবে এসবই পরমাত্মায় লীন হয়। কার্য কারণে ফিরে যায়। জগতের যখন লয় হয় তখন তা আত্মায় ফিরে যায়।