ঋগ্ভিরেতং যজুৰ্ভিরন্তরিক্ষং সামভির্যৎ তৎ কবয়ো বেদয়ন্তে।
তমোঙ্কারেণৈবায়তনেনান্বেতি বিদ্বান্ যত্তচ্ছান্তমজরমমৃতমভয়ং
পরং চেতি॥৭
অন্বয়: ঋগ্ভিঃ (ঋক্-মন্ত্রের সাহায্যে); এতম্ (এইজগৎ [নরনারীর]); যজুর্ভিঃ (যজুঃ মন্ত্রের দ্বারা); অন্তরিক্ষম্ (চন্দ্রলোক); সামভিঃ (সামমন্ত্রের সহায়ে); তৎ (সেই [ব্রহ্মলোক]); যৎ কবয়ো বেদয়ন্তে (জ্ঞানী ব্যক্তিরা জানেন); তম্ (এই ত্রিবিধ লোক); ওঙ্কারেণ এব আয়তনেন (অউম প্রতীকের মধ্য দিয়ে); বিদ্বান্ অন্বেতি (জ্ঞানী ব্যক্তি প্রাপ্ত হন); তৎ যৎ (সেই যা); শান্তম্ (শান্ত); অজরম্ (জরাহীন); অমৃতম্ (অমৃত); অভয়ম্ (ভয়ের ঊর্ধ্বে); পরং চ (সর্বোচ্চ)।
সরলার্থ: সাধক যদি ব্রহ্মরূপে ‘অউম্’কে ধ্যান করেন, তবে তিনি ঋক্-মন্ত্রের সাহায্যে মনুষ্যলোক, যজুঃমন্ত্রের দ্বারা চন্দ্রলোক এবং সামমন্ত্রের সহায়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হন। একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই এই ব্রহ্মলোক লাভ করেন। ওম্কে ঠিক ঠিক ভাবে জানতে পারলে সাধক পরম শান্তি অনুভব করেন। সাধক তখন জরা, ব্যাধি এবং সকল প্রকার ভয় থেকে মুক্ত। তখন তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন এবং পরমাত্মার সাথে এক হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: অ, উ, ম এই তিন অক্ষরের সমষ্টি হল ‘ওম্’। এর প্রতিটি অক্ষরকে বলা হয় মাত্রা। এই মাত্রা তিনটির ঊর্ধ্বে হল তুরীয় বা বিশুদ্ধ চৈতন্যের অবস্থা। ‘অ’ অক্ষরটি এই জগৎ, ঋগ্বেদ এবং জাগ্রত অবস্থার প্রতীক। ‘উ’ অক্ষরটি স্বর্গ ও মর্তের মধ্যবর্তী আকাশ, যজুর্বেদ এবং স্বপ্নাবস্থার প্রতীক। স্বর্গলোক, সামবেদ এবং সুষুপ্তি অবস্থার প্রতীক হল ‘ম’।
যদি আমরা এই তিনটি অক্ষরকে পৃথকভাবে ধ্যান করি তবে আমরা পৃথক লোক প্রাপ্ত হই। পরমাত্মারূপে ‘অ’কে ধ্যান করলে এই জগৎকে লাভ করা যায়। ‘উ’কে ধ্যান করলে চন্দ্রলোকে যাওয়া যায়। এ দুটি লোকই অজ্ঞানতার অধীন এবং তা নশ্বর। এই দুটি অক্ষরকে ধ্যান করার পর যদি আমরা ‘ম’-এর ধ্যান করি তবে আমরা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হই। যাঁরা জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁরাই একমাত্র ব্রহ্মলোকে যেতে সক্ষম। সাধক ব্রহ্মলোকে অপরব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। এই নিখিল বিশ্বের সাথে তিনি তখন এক হয়ে যান। সাধক যদি সেখানেও (ব্রহ্মলোকে) ‘অউম্’-এর ধ্যানে মগ্ন থাকেন তবে তিনি তুরীয় অবস্থা প্রাপ্ত হন। সাধক তখন পরব্রহ্ম বা শুদ্ধ চৈতন্যের সাথে এক হয়ে যান। তুরীয় অবস্থায় সাধক সমস্ত লোক এবং সকলপ্রকার বন্ধনের ঊর্ধ্বে চলে যান।
কাজেই সিদ্ধান্তটি হল—‘শান্তম্’। সাধক তখন শান্ত, স্থির। এই অবস্থায় তিনি তখন প্রশান্তি লাভ করেন। তিনি কখনও বিচলিত হন না। ‘অজরম্’—কোন বার্ধক্য বা জরা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। কারণ তিনি অসীম ও স্বতন্ত্র। তিনি সবসময়ই এক অর্থাৎ পরিবর্তন রহিত। ‘অমৃতম্’—তাঁর মৃত্যু নেই। যাঁর জন্ম হয়নি তাঁর তো কখনও মৃত্যু হতে পারে না। ‘অভয়ম্’—তিনি সকলপ্রকার ভয় থেকে মুক্ত। মৃত্যু, দুর্ভাগ্য, ইত্যাদি নানারকমের ভয়ে আমরা সবসময়ই ভীত। আমরা ভয়ের দ্বারা তাড়িত। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ করলে আর কোনও ভয় থাকে না। সাধক তখন স্থির, শান্ত ও সমাহিত। কোন কিছুই তখন তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না।
‘পরং চ ইতি’—এটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। পরম হল সর্বোচ্চ অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ পৌঁছাতে চায়। এ অবস্থায় কোন কিছুই সাধককে স্পর্শ করতে পারে না। কেউ প্রশংসা করলে আমরা খুশি হয়ে উঠি আবার কেউ নিন্দা করলে আমরা হতাশ হই। কিন্তু সাধক যখন এই অবস্থা (তুরীয় অবস্থা) প্রাপ্ত হন তখন তিনি নিন্দাস্তুতির ঊর্ধ্বে চলে যান। তিনি তখন নিরপেক্ষ। মন বশে থাকলে সাধকের কাছে এ জগৎ মজার কুটি। সেই অবস্থায় প্রশংসা বা নিন্দা দুটোই তাঁর কাছে কৌতুকের বিষয়। সাধক তখন মনে করেন, তিনি নিজেই নিজের প্রশংসা করছেন। আবার নিজেই নিজেকে দোষী বলে মনে করছেন। তিনিই ভিন্ন নাম এবং ভিন্ন রূপ নিয়ে সকলের মধ্যে রয়েছেন। সাধক যখন পরম অবস্থা লাভ করেন তখনই তাঁর মধ্যে এই একত্বের বোধ ফুটে ওঠে। অর্থাৎ সাধক তখন সকলের মধ্যে এক আত্মাকে দেখেন।
শিষ্য গুরু পিপ্পলাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সারাজীবন ধরে এই ‘ওম্’-এর ধ্যান করেন। এর দ্বারা তাঁরা কি লাভ করেন? গুরু বললেন—তাঁরা এই পরম সত্যকে লাভ করেন।
এখানেই প্রশ্ন উপনিষদের পঞ্চম প্রশ্ন সমাপ্ত।