এতদ্বৈ সত্যকাম পরং চাপরং চ ব্রহ্ম যদোঙ্কারঃ।
তস্মাদ্বিদ্বানেতেনৈবায়তনেনৈকতরমন্বেতি॥২
অন্বয়: সত্যকাম (হে সত্যকাম); যৎ (যেহেতু); ওঙ্কারঃ (ওঙ্কার); এতৎ বৈ (প্রসিদ্ধ); পরং চ অপরং চ ব্রহ্ম (নির্গুণ এবং সগুণ ব্রহ্ম); তস্মাৎ (সেইজন্য); বিদ্বান্ (যিনি জানেন); এতেন এব আয়তনেন (এর [প্রতীক] সাহায্যে); একতরম্ (উভয়ের মধ্যে একটিকে) [পরব্রহ্ম অথবা অপরব্রহ্ম]; অন্বেতি (অনুসরণ করেন)।
সরলার্থ: হে সত্যকাম, ওম্ নির্গুণ ব্রহ্ম (পরব্রহ্ম) এবং সগুণ ব্রহ্ম (অপরব্রহ্ম) এই দুই-এরই প্রতীক। যিনি একথা জানেন তিনি ওম্কে ব্রহ্মের প্রতীক রূপে ধ্যান করেন। পরিণামে তিনি যে কোন অবস্থা প্রাপ্ত হন।
ব্যাখ্যা: বেদান্ত মতে ব্রহ্মের দুটি দিক আছে: পর অর্থাৎ পরম বা নির্গুণ ব্রহ্ম। আর অপর অর্থাৎ আপেক্ষিক বা সগুণ ব্রহ্ম। আমরা অনেক সময়েই ঈশ্বর দয়ালু, ঈশ্বর মঙ্গলময়—এ কথা বলে থাকি। এ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্তাও তিনি। তখন তিনি অপরব্রহ্ম বা সগুণ ব্রহ্ম। অর্থাৎ ব্রহ্ম এখানে মায়ার দ্বারা বিশেষিত। নির্গুণ ব্রহ্ম যেন সগুণ ব্রহ্ম হয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ব্রহ্ম পরিবর্তিত হয়েছেন। ব্রহ্ম সব সময় ব্রহ্মই থাকেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি সাপের উদাহরণ দিতেন। সাপটি রাস্তায় শুয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় সাপটি মৃত। কিন্তু সাপটির কাছে গেলে সে ফণা তুলে ভয় দেখায়। সাপটি যখন রাস্তায় নিষ্ক্রিয়ভাবে শুয়ে থাকে তখন সে নির্গুণ। কিন্তু যখন সক্রিয় অর্থাৎ ফণা তুলে ফোঁস করে তখন ঐ সাপটিই সগুণ। দুটো অবস্থাতেই সেখানে কিন্তু একটি সাপই রয়েছে। ঠিক একইরকম ভাবে, পর এবং অপর, সগুণ এবং নির্গুণ উভয় অবস্থাতেই ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন।
আরেকটি দৃষ্টান্ত হল সমুদ্র এবং তার তরঙ্গ। তরঙ্গহীন সমুদ্রকে আমরা এক বিশাল জলরাশি বলে মনে করতে পারি। ঠিক তেমনি পরব্রহ্মই হলেন অনন্ত ও অদ্বিতীয় সত্তা। সমুদ্রের তরঙ্গের মতো এই অনন্ত সত্তা কখনও কখনও রূপ ধারণ করে থাকেন।
ব্রহ্ম যখন নিজেকে জগৎরূপে প্রকাশ করেন তখন তিনিই হলেন অপরব্রহ্ম অর্থাৎ পরব্রহ্মের আপেক্ষিক দিক। বেদান্ত একথা কখনই বলেন না যে, ব্রহ্মই এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন। এই জগৎ ব্রহ্মেরই প্রকাশমাত্র—সমগ্র জগৎ তাঁরই প্রকাশ। কিন্তু তা বলে এ জগৎ তাঁকে নিঃশেষ করতে পারেনি। এ জগতের সর্বত্রই তিনি রয়েছেন। সূর্য, গ্রহ, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ সকলের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান। এ জগতের ভেতরে এবং বাইরে তিনিই রয়েছেন।
অধিকাংশ মানুষই ওম্কে ব্রহ্মের প্রতীক বলে মনে করেন। এখানে উপনিষদ বলছেন, ‘ওম্’ ব্রহ্মের আপেক্ষিক বা সগুণ এবং পরম বা নির্গুণ—এই দুটি অবস্থারই প্রতীক। ব্রহ্মের প্রতীক রূপে ওম্কে ধ্যান করলে যে-কোন একটি অবস্থা (পর বা অপর ব্রহ্ম) লাভ করা যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা প্রতীক ব্যবহার করি কেন? মনে করা যাক, একজন ‘জল’ এই শব্দটি বলল। সঙ্গে সঙ্গে জল বলতে যা বোঝায় তা যেন আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। আমরা যখন ব্রহ্ম এই শব্দটা বলি তখন এটা কি আমাদের নির্দিষ্ট কিছু মনে করিয়ে দেয়? আমরা কি মানসচক্ষে এমন কিছু দেখতে পাই যা ব্রহ্ম নামে পরিচিত? না। আচার্য শঙ্করের মতে ব্রহ্ম নির্গুণ এবং ইন্দ্রিয়াতীত। নির্দিষ্ট নাম ও রূপ আছে বলে আমি কোন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নেই।
প্রতীককে আমরা চাক্ষুষ দেখতে পাই এবং তাতে মনকে একাগ্র করতে পারি। আমরা যে মূর্তি বা ছবি পুজো করে থাকি এও যেন ঠিক তাই, আমরা কিন্তু মাটি বা কাগজকে পূজা করি না। এই মূর্তি বা ছবি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা আমাদের মনকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি দৃষ্টান্ত দিতেন। তিনি বলতেন : তোমার আঙ্গুলে একটি কাঁটা ফুটেছে। তুমি কেমন করে এই কাঁটাটিকে বার করবে? তুমি আর একটি কাঁটা নেবে এবং এর সাহায্যে প্রথম কাঁটাটিকে তুলে আনবে, তারপর দুটো কাঁটাকেই ছুড়ে ফেলে দেবে। ঠিক তেমনি, আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্রহ্মকে ধ্যান করার জন্য আমরা প্রতীকের সাহায্য নিয়ে থাকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতীক প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোন সাহায্য করে কি? শাস্ত্রমতে, প্রতীক আমাদের অবশ্যই সাহায্য করে।
কিন্তু ব্রহ্মের প্রতীক হিসাবে ‘ওম্’কেই বেছে নেওয়া হয়েছে কেন? কারণ ব্রহ্মই ‘সব’ এবং তিনিই ‘সব’ কিছু হয়েছেন। ব্রহ্ম যে ‘সব’ একথা ধারণা করা কঠিন। আবার এই ‘সব’কে বর্ণনা করাও সহজ কাজ নয়। শব্দরূপে ‘ওম্’ই সকল শব্দের মধ্যে রয়েছেন। সব শব্দের প্রতীকই হলেন এই ‘ওম্’। যখন আমরা ‘ওম্’ উচ্চারণ করি তখন গলার পেছনদিক থেকে বদ্ধ ওষ্ঠ পর্যন্ত প্রতিটি অংশকেই আমরা স্পর্শ করে থাকি। অ, উ এবং ম—একযোগে সব শব্দের উৎস। এই কারণের জন্যই ‘ওম্’ ব্রহ্মের সব থেকে উপযুক্ত প্রতীক। এই কারণেই ‘ওম্’কে শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম বলা হয়ে থাকে। আমরা যদি ব্রহ্মকে কোন শব্দরূপে কল্পনা করে থাকি তবে ওম্ই হলেন সেই শব্দ। ওম্কে ধ্যান করলে ব্রহ্মকেই ধ্যান করা হয়। ‘ওম্’ আমাদের সবসময় মনে করিয়ে দেন আমরাই ব্রহ্ম।
শঙ্করাচার্য ওম্কে বিষ্ণুর সাথে তুলনা করেছেন; ভক্তরা অনুরাগের সাথে যাঁর (বিষ্ণুর) ধ্যান করেন। একইভাবে, কেউ যদি অনুরাগের সাথে ওম্-এর ধ্যান করেন তাহলে ব্ৰহ্ম তাঁর প্রতি প্রসন্ন হন। আচার্য শঙ্কর বলছেন, ‘ইতি অবগম্যতে শাস্ত্রপ্রামাণ্যাৎ’—একথা শাস্ত্রও বলে থাকেন।