স যথা সোম্য বয়াংসি বাসোবৃক্ষং সংপ্রতিষ্ঠন্তে।
এবং হ বৈ তৎ সর্বং পর আত্মনি সংপ্রতিষ্ঠতে॥৭
পৃথিবী চ পৃথিবীমাত্রা চাপশ্চাপোমাত্ৰা চ তেজশ্চ তেজোমাত্রা চ
বায়ুশ্চ বায়ুমাত্রা চাকাশশ্চাকাশমাত্রা চ চক্ষুশ্চ দ্রষ্টব্যং চ শ্রোত্রং চ
শ্রোতব্যং চ ঘ্রাণং চ ঘ্রাতব্যং চ রসশ্চ রসয়িতব্যং চ ত্বক্ চ
স্পর্শয়িতব্যং চ বাক্ চ বক্তব্যং চ হস্তৌ চাদাতব্যং
চোপস্থশ্চানন্দয়িতব্যং চ পায়ুশ্চ বিসর্জয়িতব্যং চ পদৌ চ গন্তব্যং চ
মনশ্চ মন্তব্যং চ বুদ্ধিশ্চ বোদ্ধব্যং চাহংকারশ্চাহংকর্তব্যং চ চিত্তং চ
চেতয়িতব্যং চ তেজশ্চ বিদ্যোতয়িতব্যং চ প্রাণশ্চ বিধারয়িতব্যং চ॥৮
অন্বয়: সোম্য (হে সৌম্য); সঃ (সে একটি দৃষ্টান্ত); যথা (ঠিক যেমন); বয়াংসি (পাখীরা); বাসোবৃক্ষম্ (যে গাছে তারা বাস করে); সংপ্রতিষ্ঠন্তে (ফিরে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে); এবং হ বৈ (একই প্রকারে); তৎ সর্বম্ (সব বস্তু); পরে আত্মনি সংপ্রতিষ্ঠতে (পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠিত হয়)। পৃথিবী চ পৃথিবীমাত্রা চ (পৃথিবী এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); আপঃ চ আপোমাত্রা চ (জল এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); তেজঃ চ তেজোমাত্রা চ (অগ্নি এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); বায়ুঃ চ বায়ুমাত্রা চ (বায়ু এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); আকাশঃ চ আকাশমাত্রা চ (আকাশ এবং তার সূক্ষ্ম রূপ); চক্ষুঃ চ দ্রষ্টব্যং চ (চোখ এবং চোখ যা দেখে); শ্রোত্রং চ শ্রোতব্যং চ (কান এবং কান যা শোনে); ঘ্রাণং চ ঘ্রাতব্যং চ (নাক এবং নাক যা গন্ধ গ্রহণ করে); রসঃ চ রসয়িতব্যং চ (জিভ এবং জিভ যা স্বাদ গ্রহণ করে); ত্বক্ চ স্পর্শয়িতব্যং চ (ত্বক এবং ত্বক যা স্পর্শ করে); বাক্ চ বক্তব্যং চ (বাগিন্দ্রিয় এবং বক্তব্য বিষয়); হস্তৌ চ আদাতব্যং চ (হাত এবং হাত যা গ্রহণ করে); উপস্থঃ চ আনন্দয়িতব্যং চ (উপস্থ এবং তার ভোগ্য বিষয়); পায়ুঃ চ বিসর্জয়িতব্যং চ (পায়ু এবং মলমূত্রাদি বর্জন); পাদৌ চ গন্তব্যং চ (পা এবং তার গন্তব্যস্থল); মনঃ চ মন্তব্যং চ (মন এবং তার মনন); বুদ্ধিঃ চ বোদ্ধব্যং চ (বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিষয়); অহঙ্কারঃ চ অহঙ্কৰ্তব্যং চ (অহঙ্কার এবং তার বিষয়); চিত্তং চ চেতয়িতব্যং চ (স্মৃতি এবং তার বিষয়); তেজঃ চ বিদ্যোতয়িতব্যং চ (জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয়); প্রাণঃ চ বিধারয়িতব্যং চ (প্রাণ এবং প্রাণ যা ধারণ করে) [এই সবকিছু পরমাত্মায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে]।
সরলার্থ: হে সৌম্য, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, পাখীরা যেমন গাছে তাদের বাসার দিকে উড়ে যায়, ঠিক তেমনি এ জগতের সবকিছুই পরমাত্মায় আশ্রয় গ্রহণ করে। অর্থাৎ পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়।
পৃথিবী ও তার সূক্ষ্ম রূপ (গন্ধ), জল ও তার সূক্ষ্ম রূপ (স্বাদ বা রস), অগ্নি ও তার সূক্ষ্ম রূপ (রূপ), বায়ু ও তার সূক্ষ্ম রূপ (স্পর্শ), আকাশ ও তার সূক্ষ্ম রূপ (শব্দ), চোখ এবং চোখ যা দেখে, কান এবং কান যা শোনে, নাক এবং নাক যা গন্ধ নেয়, জিভ এবং জিভ যা স্বাদ গ্রহণ করে, ত্বক এবং ত্বক যা স্পর্শ করে, বাগিন্দ্রিয় ও বক্তব্য বিষয়, হাত এবং হাত যা গ্রহণ করে, জননেন্দ্রিয় ও তার ভোগ্য বিষয়, পায়ু এবং মলমূত্রাদি বর্জন, পা এবং তার গন্তব্যস্থল, মন এবং তার মনন, বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিষয়, অহঙ্কার ও তার বিষয়, স্মৃতি এবং তার বিষয়, জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয়, প্রাণ ও প্রাণ যা ধারণ করে—এই সবকিছুই পরমাত্মাতে বিলীন হয়।
ব্যাখ্যা (Verse 7): সুষুপ্তিতে জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয় এবং আমরা তখন আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু এটি শুদ্ধ চৈতন্যের অবস্থা নয় এবং এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিলাভও করতে পারি না। সুষুপ্তি অবস্থা, সমাধি অর্থাৎ শুদ্ধ চৈতন্য অবস্থার মতো হলেও দুটি অবস্থা পুরোপুরি এক নয়। সুষুপ্তিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে একটা ভেদ থাকে। এই ভেদই হল অজ্ঞানতা। এই অবস্থাতেও আমাদের মধ্যে অজ্ঞানতা থাকে কিন্তু তখন তা নিষ্ক্রিয়। সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জেগে উঠি তখন আমরা আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে যাই। অর্থাৎ নিদ্রার পূর্বে যেখানে ছিলাম। যেখানে সংগ্রাম শেষ হয়েছিল আবার সেখান থেকেই আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়। কারণ আত্মা সম্পর্কে আমরা তখনও অজ্ঞ। সুষুপ্তিতে দুই বোধ সাময়িকভাবে দূর হয় বটে কিন্তু অজ্ঞানতা তখনও পুরোমাত্রায় থাকে।
সুষুপ্তির অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আচার্য শঙ্কর এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অনেকক্ষণ যাবৎ পাখীরা হয়তো উড়ে বেড়াচ্ছে। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হওয়ায় তারা বাসায় ফিরে যাবে স্থির করল। একই কথা আমাদের বেলাতেও সত্য। পাখীদের মতো আমরাও চারিদিকে ঘুরে বেড়াই। তারপর একসময়ে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফিরে যেতে চাই। সুষুপ্তিতে আমরা পরমাত্মার সাথে মিলিত হই এবং আনন্দ অনুভব করে থাকি।
আচার্য শঙ্করের মতে, জাগ্রত অবস্থায় আমরা অবিদ্যা, কামনা-বাসনা এবং কর্মের অধীন। অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা আছে বলেই আমাদের কামনা-বাসনা আছে। এই বাসনা থেকেই কর্মের সৃষ্টি। অর্থাৎ অপূর্ণ বাসনা মেটাতেই আমরা কাজ করে থাকি। আমরা ভাল বা খারাপ দু-রকমেরই কাজ করতে পারি। ভাল কাজ করলে আমরা ভাল ফল লাত করি। আবার খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল ভোগ করি। অর্থাৎ আমরা কর্মফলের অধীন। এভাবেই আমরা কার্য-কারণ শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ি।
সুষুপ্তি অবস্থায় কামনা-বাসনা অর্থাৎ দুই বোধ সাময়িকভাবে দূর হয় এবং আমাদের দেহ ও মন তখন কোন কাজ করে না। আমাদের উপাধিসমূহ যেমন ‘অহংতা’ (আমি) আর মমতা (আমার) ইত্যাদি আমাদের সীমাবদ্ধ করে। এইসব উপাধির জন্য আমরা নিজেদেরকে লম্বা-বেঁটে, সুখী-অসুখী বলে মনে করে থাকি। সুষুপ্তিতে এইসব বোধ থাকে না। শঙ্করাচার্যের মতে সুষুপ্তিতে আমরা ‘অদ্বয়ম্ একম্ শিবং শান্তম্’ অবস্থা প্রাপ্ত হই। এই অবস্থায় কোন দুই বোধ থাকে না (অদ্বয়ম্)। থাকে কেবল এক চৈতন্য। এবং এই চৈতন্য শান্তি (শান্তম্)। আমাদের অজ্ঞানতাপ্রসূত এই জগতের অস্তিত্ব তখন লোপ পায়।
ব্যাখ্যা (Verse 8): হিন্দুদর্শন অনুসারে, এই জগৎ পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি। উপাদানগুলি হল: ক্ষিতি, অপ্, তেজঃ, মরুৎ, ব্যোম। এই উপাদানগুলির আবার দুটি দিক আছে, স্থূল এবং সূক্ষ্ম। উপাদানগুলি বিভিন্ন মাত্রায় একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে এই দৃশ্যমান জগৎ সৃষ্টি করে।
পৃথিবী স্থূলরূপে পাঁচটি গুণবিশিষ্ট—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। কিন্তু সূক্ষ্মরূপে পৃথিবী একটি গুণবিশিষ্ট এবং তা হল গন্ধ।
সূক্ষ্ম উপাদান থেকে স্থূল উপাদানে পরিণত হওয়ার উপায়টি হল: প্রত্যেকটি উপাদান দুই ভাগে বিভক্ত। ধরা যাক, পৃথিবী এই উপাদানটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তারপর এর (পৃথিবী উপাদান) এক ভাগ নিয়ে, তার সঙ্গে চারটি উপাদানের প্রত্যেকটির থেকে এক অষ্টমাংশ নিয়ে যোগ করা হল, তখন এই সূক্ষ্ম পৃথিবী স্থূল পৃথিবীতে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি উপাদানই সূক্ষ্ম থেকে স্থূলে পরিণত হবে যদি উপাদানগুলি নির্দিষ্ট অনুপাতে অপর উপাদানগুলির সাথে মিলিত হয়।
সূক্ষ্ম অবস্থায় উপাদানগুলিকে বলা হয় ‘তন্মাত্র’ অর্থাৎ শুধু সেটিই থাকে। একে ‘অপঞ্চীকৃত’ও বলা হয়ে থাকে। ‘অপঞ্চীকৃত’ যা অন্য কোন উপাদানের সাথে মিলিত নয় অর্থাৎ যা অবিমিশ্র। এই অবস্থায় উপাদানগুলিকে শুধুমাত্র তার গুণের দ্বারা চেনা যায়; যেমন গন্ধের দ্বারা পৃথিবীকে, রস বা স্বাদের দ্বারা জলকে, রূপের দ্বারা অগ্নিকে, স্পর্শ দ্বারা বায়ুকে, এবং শব্দের দ্বারা আকাশকে। সমস্ত উপাদানগুলির যোগ বিয়োগই হচ্ছে এই দৃশ্যমান জগৎ।
আমাদের ইন্দ্রিয় আছে এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ভোগ্য বিষয়ও আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চোখ এবং চোখের বিষয়, অর্থাৎ চোখ দিয়ে আমরা যেসব বস্তু দেখে থাকি।
কিন্তু আমাদের অবশ্যই অন্তরিন্দ্রিয়ও আছে যা বাইরের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অন্তরিন্দ্রিয় হল মন। মনের কাজ কি? মন প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় বিচার করে দেখে। মন প্রত্যেকটি বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করে। এক অবস্থায় মনকে বুদ্ধি বলা হয়ে থাকে। আমাদের কি করা উচিত বুদ্ধিরূপে মনই তা স্থির করে।
মনকে আবার হৃদয় বলেও উল্লেখ করা হয়। হৃদয়রূপে এই মনেই আমাদের অনুভূতি, আবেগ ও অভিজ্ঞতাসমূহ সঞ্চিত থাকে। মনের আর একটি দিক হল অহঙ্কার অর্থাৎ আমিত্ববোধ। এই ‘অহংতা’র ফলেই আমরা নিজেদেরকে ‘আমি ধনী, আমি বিদ্বান’ ইত্যাদি মনে করে থাকি।
তেজঃ কথার অর্থ হল যা আলোকিত করে। প্রাণঃ কথার অর্থ হল যা আমাদেরকে ধারণ করে রাখে। এখানে প্রাণ বলতে সূত্ৰাত্মা বা হিরণ্যগর্ভকে বোঝানো হয়েছে।