স যদা তেজসাঽভিভূতো ভবতি। অত্রৈষ দেবঃ স্বপ্নান্ন পশ্যত্যথ
তদৈতস্মিঞ্শরীর এতৎ সুখং ভবতি॥৬
অন্বয়: সঃ (এই মন); যদা (যখন); তেজসা অভিভূতঃ ভবতি (আত্মার আলোয় অভিভূত); অত্র (স্বপ্নহীন এই নিদ্রিত অবস্থায় অর্থাৎ সুষুপ্তিতে); এষঃ দেবঃ (মন); স্বপ্নান্ ন পশ্যতি (স্বপ্ন দেখে না [কারণ যে দ্বারপথে বাসনাসমূহ আমাদের মনে প্রবেশ করে তখন সাময়িকভাবে সেই দরজা বন্ধ থাকে]); অথ তদা (সেই সময় [অর্থাৎ স্বপ্নহীন নিদ্রায় বা সুষুপ্তিতে]); এতস্মিন্ শরীরে (এই শরীরে); এতৎ সুখং ভবতি (সমস্ত শরীরে এবং মনে এক প্রশান্তি বিরাজ করে)।
সরলার্থ: আত্মার মহিমায় মন যখন অভিভূত অর্থাৎ মনের মধ্যে বাসনা প্রবেশের দরজা যখন বন্ধ, সেই সুষুপ্তি অবস্থায় মন কোন স্বপ্ন দেখে না। এই সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমাদের দেহ ও মন খুব সতেজ হয়।
ব্যাখ্যা: জাগ্রত অবস্থায় আমাদের শরীর, মন এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে। যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি বা স্বপ্ন দেখি তখন আমাদের শরীর নিষ্ক্রিয় থাকলেও মন কিন্তু তখনও কাজ করে চলে। এমন স্বপ্নও আমরা দেখি যে, আমরা অনেক কাজ করছি। কিন্তু আসলে আমি তো তখন বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু মনে করছি কত কাজ করছি। এমনকি এটা যে অবাস্তব কল্পনা, একথা আমাদের একবারও মনে হয় না।
কখনও কখনও গভীর নিদ্রায় আমাদের মন এবং শরীর কোনটাই কাজ করে না। তখন কোন কিছু আছে বলেই আমাদের মনে হয় না। আবার ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে উঠতে পারি না আমরা কোথায় আছি বা তখন দিন না রাত অর্থাৎ চারপাশের সবকিছুকে বুঝে উঠতে আমাদের সময় লাগে। যদিও তখন আমরা অত্যন্ত সতেজ এবং প্রসন্ন বোধ করি। তাহলে তখন কি ঘটেছিল? মৃত্যু? না। এরকম অবস্থাকে বলা হয় সুষুপ্তি।
বেদান্তে জীবাত্মা ও পরমাত্মার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্বরূপত আত্মা দুই নয়, এক ও অদ্বিতীয়। পরমাত্মা যখন দেহ, ইন্দ্রিয় ও মনের সঙ্গে যুক্ত তখনই তা জীবাত্মা। নামরূপের বিভিন্নতার জন্য আমরা নিজেদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা বলে মনে করি। আমাদের মধ্যে কেউ হয়তো লম্বা আবার কেউ বেঁটে, কেউ ফরসা কেউ বা কালো, আবার কেউ ভারতীয় কেউ বা বিদেশী—এরকম থাকতেই পারে। আমাদের মধ্যে এই যে পার্থক্য এর ফলে আমরা নিজেদের একে অপরের থেকে পৃথক বলে মনে করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের সকলের মধ্যে একই সত্তা রয়েছে। সেই অনন্ত সত্তাই হলেন পরমাত্মা। আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন নামরূপের দ্বারা এই এক পরমাত্মাই চিহ্নিত হয়েছেন। এবং তখন তাঁকে বলা হয় জীবাত্মা।
বেদান্ত বলেন, সুষুপ্তি অবস্থায় কোন বিষয়বোধ অর্থাৎ কোন দুই বোধ থাকে না। যে অজ্ঞানতার জন্য আমরা নিজেদের দেহ এবং মনের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করি, সেই অজ্ঞানতা তখন সাময়িকভাবে দূর হয়। এবং সবকিছু তখন চৈতন্যময় হয়ে ওঠে।
জাগ্রতাবস্থাতেও আমাদের মধ্যে চৈতন্য থাকে। হয়তো তা খুবই সামান্য, যার দ্বারা আমরা দেখি, শুনি, বা কথা বলি। এ যেন একটি বাতিকে জ্বালাবার জন্য অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো। কিন্তু উপনিষদ বলেন, সুষুপ্তি অবস্থায় আমরা চৈতন্যের আলোয় অভিভূত হই (তেজসা অভিভূতঃ)। সেই সময় জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। জীবাত্মার আলাদা কোন অস্তিত্ব বোধ থাকে না। সুষুপ্তি অবস্থায় মানুষ পরিপূর্ণ আনন্দ ও সুখ অনুভব করে।