প্রাণাগ্নয় এবৈতস্মিন্ পুরে জাগ্ৰতি। গার্হপত্যো হ বা এষোঽপানো
ব্যানোঽন্বাহার্যপচনো যদ্গার্হপত্যাৎ প্ৰণীয়তে প্রণয়নাদাহবনীয়ঃ প্রাণঃ॥৩
অন্বয়: এতস্মিন্ পুরে (এই শরীরে যা একটি নগরের সমান); প্রাণাগ্নয়ঃ এব জাগ্রতি (অগ্নিস্থানীয় এ প্রাণই সবসময় জেগে থাকে); এষঃ অপানঃ হ বৈ গার্হপত্যঃ (অপানই গার্হপত্য নামক অগ্নি); ব্যানঃ অন্বাহার্যপচনঃ (ব্যান বায়ুই দক্ষিণাগ্নি); যৎ (যেহেতু); গার্হপত্যাৎ (গার্হপত্য অগ্নি থেকে); প্ৰণীয়তে (পৃথকরূপে গৃহীত); প্রণয়নাৎ (এই পৃথক করার দ্বারা); প্রাণঃ আহবনীয়ঃ (প্রাণকেই আহবনীয় বলা হয়ে থাকে)।
সরলার্থ: এই দেহ একটি নগরের মতো। আমরা যখন ঘুমোই তখন অগ্নির সমান যে প্রাণ তা জেগে থাকে। অপান হল গার্হপত্য অগ্নি। আর ব্যান হল ‘অন্বাহার্যপচনঃ’ অর্থাৎ দক্ষিণাগ্নি। কারণ প্রাণকে গার্হপত্য অগ্নি থেকে নেওয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যা: এই দেহকে কখনও কখনও পুর বা নগর বলা হয়ে থাকে। কারণ নগরের ভেতর ঢোকার জন্য অনেক দরজা থাকে। শরীরের দরজা বলতে দুটি চোখ, দুটি কান ও নাসারন্ধ্র ইত্যাদি বোঝায়। এই জগৎ সম্পর্কে যা কিছু অভিজ্ঞতা তা আমরা এই দরজার মাধ্যমেই লাভ করে থাকি।
প্রাচীনকালে গৃহস্থরা নির্দিষ্ট কিছু যাগযজ্ঞ করতেন। কোন কোন যন্ত্র প্রতিদিন করা হত আবার কোন কোন যজ্ঞ বিশেষ বিশেষ সময়ে করা হত। এই যজ্ঞসকল বিশাল, অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আজকাল আর এইসব যাগযজ্ঞ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু উপনিষদ বলেন, এর বিকল্পও আছে। যেমন মানসপূজা অর্থাৎ মনে মনে পূজা করা। আমরা দেবতাকে মনে মনে ফল ফুল ইত্যাদি নানা অর্ঘ্য নিবেদন করে থাকি। ঠিক তেমনি শ্বাসকার্য এবং প্রাণের অন্যান্য কাজকর্মকে আমরা যাগযজ্ঞ বলে মনে করতে পারি। উপনিষদে ‘অগ্নিহোত্র’ যজ্ঞের কথা আছে। অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করতে হলে তিন রকমের অগ্নির প্রয়োজন, যথা—গার্হপত্য, আহবনীয় এবং দক্ষিণাগ্নি (অন্বাহার্যপচনঃ)। গার্হপত্য অগ্নির আগুন কখনও নেভে না। যজ্ঞের সময় গার্হপত্য অগ্নি থেকে আগুন নিয়ে আহবনীয় অগ্নিকে জ্বালানো হয়। অর্থাৎ অন্য অগ্নি থেকে এই আগুন নেওয়া হয় বলে এর নাম আহবনীয়। দক্ষিণাগ্নিও গার্হপত্য থেকে নেওয়া হয়। যজ্ঞবেদীর দক্ষিণ ভাগে থাকে বলে এর নাম দক্ষিণাগ্নি।
একইভাবে আমাদের দেহে প্রাণাগ্নি সবসময় জ্বলতে থাকে অর্থাৎ সবসময়ই তা সক্রিয়; যতক্ষণ আমরা জীবিত আছি ততক্ষণ আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এবং ইন্দ্রিয়সকল প্রাণশক্তির মধ্য দিয়ে কাজ করে থাকে। অপান হল শ্বাসবায়ু ত্যাগ করা। অপানবায়ু যেহেতু সবসময়ই রয়েছে এবং এটা অপরিহার্য তাই একে গার্হপত্যের সাথে তুলনা করা হয়। যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখন প্রাণবায়ু অপানবায়ুর জায়গা দখল করে এবং মুখ ও নাসাপথে বেরিয়ে আসে। এই কারণেই প্রাণবায়ুকে আহবনীয় অগ্নির সাথে তুলনা করা হয়েছে। ব্যানকে দক্ষিণাগ্নিও বলা হয় কারণ ব্যান দক্ষিণ নাসারন্ধ্র দিয়ে নির্গত হয় (যা দক্ষিণদিকরূপে মনে করা হয়)।
যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি প্রাণের এই অগ্নিসকল তখনও কাজ করে চলে, মনে হয় আমরা যেন যজ্ঞ করছি। আমাদের শরীরের নানা ইন্দ্রিয় ও তাদের কার্যকলাপকে অন্তরস্থ আত্মার (আমাদের সকলের মধ্যে যে আত্মা আছেন) উপাসনা করছি বলে মনে করতে হবে।
এখানে একটা আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে। যদি আমি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে থাকি তখন আমার আর কোন প্রার্থনা, যাগযজ্ঞ, মূর্তিপূজা ইত্যাদির প্রয়োজন থাকে না। এমনকি তীর্থভ্রমণ ও শাস্ত্রপাঠেরও তখন আর দরকার হয় না। সমগ্র জীবনই প্রার্থনায় পরিণত হয়। পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক এই দুই-এর মধ্যে তখন কোন ভেদ থাকে না। সবই তখন আধ্যাত্মিক। আমাদের শ্বাসক্রিয়াও তখন পূজায় পরিণত হয়।