অথ হৈনং সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ পপ্রচ্ছ। ভগবন্নেতস্মিন্ পুরুষে
কানি স্বপন্তি কান্যস্মিঞ্জাগ্রতি কতর এষ দেবঃ স্বপ্নান্ পশ্যতি
কস্যৈতৎ সুখং ভবতি কস্মিন্নু সর্বে সম্প্রতিষ্ঠিতা ভবন্তীতি॥১
অন্বয়: অথ হ (তারপরে); সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ (গর্গ বংশের সৌর্যায়ণী); এনং পপ্ৰচ্ছ (তাঁকে [পিপ্পলাদকে] জিজ্ঞাসা করলেন); ভগবন্ (ভগবান); এতস্মিন্ পুরুষে (এই শরীরে); কানি স্বপন্তি (কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায়); অস্মিন্ কানি জাগ্ৰতি (একই শরীরের কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় জেগে থাকে); কতরঃ এষঃ দেবঃ [এই দুই দেবতার মধ্যে কোন্টি] (একটি নিদ্রিত এবং অপরটি জাগ্রত); স্বপ্নান্ পশ্যতি (স্বপ্ন দেখে); কস্য এতৎ সুখং ভবতি (কে সেই [সুষুপ্তির] আনন্দ উপভোগ করে); কস্মিন্ নু (কার উপর); সর্বে সম্প্রতিষ্ঠিতাঃ ভবন্তি ইতি (এই সকলে আশ্রয় গ্রহণ করে)?
সরলার্থ: তারপরে গর্গ বংশের সৌর্যায়ণী পিপ্পলাদকে প্রশ্ন করলেন, হে ভগবান, মানুষের শরীরে কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয় নিদ্রা যায় এবং বিশ্রাম গ্রহণ করে? কোন্ কোন্ ইন্দ্রিয়ই বা জেগে থাকে এবং কাজ করে? এই দুই প্রকার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে (একটি সক্রিয়,অপরটি নিষ্ক্রিয়).কোন্টি বা স্বপ্ন দেখে? সুষুপ্তির আনন্দই বা কে উপভোগ করে? সুষুপ্তির অবস্থায় সকল ইন্দ্রিয় কোথায়ই বা যায়?
ব্যাখ্যা: সমগ্র জীবকুলই এই নিদ্রা নামক অভিজ্ঞতার অধীন। শুধুমাত্র মানুষই নয়, পশু, পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সকলেই ঘুমোয়। কিন্তু আমাদের দেহের কোন্ অংশটি ঘুমোয়? দেহ? ইন্দ্রিয়? কিংবা আর কিছু? এটা খুব সহজ প্রশ্ন। বস্তুত আমাদের সকলেরই এই তিন রকম অভিজ্ঞতা হয়—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। এখন প্রশ্ন হল, কে স্বপ্ন দেখে? এই দেহের মধ্যে কোন অংশটি জেগে থাকে? আমরা বলে থাকি, ‘আমি অমুক’। আমরা সকলেই এই ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এই ‘আমি’ই বা কে?
যখন আমরা জেগে থাকি তখন আমাদের শরীর এবং মন দুই-ই সক্রিয় থাকে। কিন্তু নিদ্রাবস্থায় আমাদের শরীর কোন কাজ করে না কিন্তু মন তখনও সক্রিয় থাকে। আমরা হয়তো বিছানায় শুয়ে আছি কিন্তু দেখছি আমি কাশী গেছি। আবার সুষুপ্তি অবস্থায় আমাদের দেহ, মন, দুই-ই তখন নিষ্ক্রিয়। উভয়ই তখন স্থির থাকে। তখন ইন্দ্রিয়সকল মনে লয় হয়, তাদের আর কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না।
বিভিন্ন নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়লে নদীর যেমন কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, এও যেন ঠিক তাই। এই গভীর নিদ্রা বা সুষুপ্তি অবশ্যই মুক্তি বা মোক্ষ নয়—কারণ অজ্ঞানতা তখনো বিদ্যমান। কাজেই সুষুপ্তি ভাঙ্গার পর আমরা যখন জেগে উঠি তখন পূর্বে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে আসি। এইমাত্র লাভ হয় যে, গভীর নিদ্রার পরে জাগ্রত হয়ে আমরা অত্যন্ত সতেজ বোধ করি।
আচার্য শঙ্কর বলেছেন, পূর্বের প্রশ্নগুলি অপরা বিদ্যা সংক্রান্ত। এটাই স্বাভাবিক, প্রথমে আমাদের আগ্রহ থাকে এই শরীর ও জগৎকে ঘিরে। আমরা হয়তো বিজ্ঞান, ইতিহাস, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারি। এইসব জানা ভাল। কিন্তু এই জ্ঞানই শেষ নয়। আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন অর্থাৎ পরা বিদ্যা লাভ করাই হল প্রকৃত জ্ঞান।
ধীরে ধীরে আমরা এই জাগতিক বিষয় থেকে দূরে সরে যাই, কারণ আমরা অনুভব করি এই দৃশ্যমান জগৎই সব নয়। এই জগতের বাইরেও আরও কিছু আছে যা ইন্দ্রিয়াতীত। এমন কিছু আছে যা এই জগৎকে ধরে রেখেছে। এই বিশ্ব সতত পরিবর্তনশীল। এই ক্রমাগত পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এই জগতের এমন কোন আশ্রয় আছে যা নিত্য এবং অপরিবর্তনীয়। এমন কোন সত্তা অবশ্যই আছেন যা আমাদেরও ধরে রেখেছেন। সেই সত্তাটি কি? সেই অপরিবর্তনীয় সত্তা হল—‘আত্মা’।
আত্মা আমাদের বাইরেও আছেন আবার ভেতরেও আছেন। বেদান্ত বলেন—যা বাইরে তাই অন্তরে। সমষ্টির ক্ষেত্রে যা সত্য ব্যষ্টির ক্ষেত্রেও তা সত্য। যে বিরাট ও বৈচিত্রময় জগৎ বাইরে আছে সেই জগৎই আবার ক্ষুদ্ররূপে আমাদের মনেও আছে। বস্তুত বাহির এবং অন্তর বলে আসলে কিছু নেই।
এই প্রসঙ্গে বেদান্ত একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। একটি পাত্রকে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। ঐ পাত্রটির ভেতরে জল আছে, আবার বাইরেও আছে। আপাতদৃষ্টিতে পাত্রটি জলকে দুইভাগে ভাগ করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে এক জলই পাত্রটির ভিতরে ও বাইরে আছে। ঠিক সেরকমভাবে একই আত্মা এই জগৎকে এবং আমাদের দেহকেও ধরে রেখেছেন।
আত্মা এবং এই দৃশ্যমান জগতের বস্তুসমূহের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে মুণ্ডক উপনিষদ অগ্নি ও তার স্ফুলিঙ্গের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সব বস্তুই আত্মা থেকে এসেছে আবার আত্মাতেই ফিরে যাবে। বস্তুসমূহের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই।