আত্মন এষ প্রাণো জায়তে যথৈষা পুরুষে ছায়ৈতস্মিন্নেতদাততং
মনোকৃতেনায়াত্যস্মিঞ্শরীরে॥৩
অন্বয়: এষঃ প্রাণঃ আত্মনঃ জায়তে (এই প্রাণ আত্মা থেকে আসেন); পুরুষে যথা ছায়া (যেমন দেহের একটি ছায়া আছে); [একই ভাবে] এতৎ (এই [প্রাণ]); এতস্মিন্ (আত্মাতে); আততম্ (অন্তর্নিহিত); মনোকৃতেন (ইচ্ছা হলে); অস্মিন্ শরীরে আয়াতি (এই স্থূল দেহে আসেন)।
সরলার্থ: প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। দেহকে আশ্রয় করে যেমন ছায়া থাকে তেমনি আত্মায় প্রাণ নিহিত রয়েছেন। ইচ্ছা হলে এই প্রাণ স্থূল শরীর ধারণ করেন।
ব্যাখ্যা: আত্মা থেকে অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকে প্রাণের উৎপত্তি। সবকিছু সেই এক আত্মা থেকে আসে আবার আত্মাতেই ফিরে যায়। সমুদ্রে তরঙ্গ ওঠে, কিছুক্ষণ থেকে আবার তা সমুদ্রেই মিশে যায়। এই তরঙ্গরাশিকে কি সমুদ্র থেকে আলাদা করা যায়? না, তা সম্ভব নয়।
উপনিষদ প্রাণকে ছায়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমাদের শরীর আছে এবং তার ছায়াও আছে। এই ছায়া কোথা থেকে আসে? শরীর থেকে। অনুরূপভাবে প্রাণ আত্মা থেকে আসেন। প্রাণকে আত্মা থেকে পৃথক করা যায় না—যেমন তরঙ্গকে সমুদ্র থেকে বা ছায়াকে দেহ থেকে পৃথক করা যায় না। আচার্য শঙ্কর বলেন, এই ছায়া ‘অনৃত’ অর্থাৎ অসত্য। ছায়ায় কোন বস্তু নেই, অতএব তা স্বতন্ত্র নয়। ঠিক সেইরকম প্রাণ সম্পূর্ণভাবে আত্মার উপর নির্ভরশীল এবং সেই অর্থে অসত্য বা মিথ্যা। প্রাণকে যে সত্য বলে মনে হয় তার কারণ প্রাণ সত্যকে অর্থাৎ আত্মাকে আশ্রয় করে আছেন। আবার একই অর্থে জগৎও সত্য যেহেতু সত্যই জগৎকে ধরে আছেন। সেই সত্যস্বরূপই জগতের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হন।
পরবর্তী প্রশ্ন ছিল—প্রাণ কিভাবে শরীরে প্রবেশ করেন? উপনিষদ বলেন, আমাদের মনের গতি (মনোকৃতেন) অর্থাৎ আমাদের প্রবণতা, আকাঙ্ক্ষা, সঙ্কল্প ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের দেহের গঠন হয়। মনই শরীরকে সৃষ্টি করে। কেউ হয়তো সবল, সুন্দর দেহের অধিকারী; আবার কারোর দেহ জীর্ণ, দুর্বল। তাছাড়া অন্যান্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গ তো আছেই। আবার মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যাঁরা নরোত্তম।
সুন্দর মনই সুন্দর দেহ সৃষ্টি করে। যে মন সবসময় সৎ চিন্তা করে, ঘৃণা ক্রোধ ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেয় না সেই মনই সুন্দর। আর যাঁরা সুন্দর মনের অধিকারী তাঁরা বলেন, ‘এই শরীর ভোগের জন্যে নয়, বাসনা চরিতার্থ করার জন্যেও নয়। শরীর থাকলে আমরা শাস্ত্রপাঠ করতে পারি, সত্যকে জানার চেষ্টা করতে পারি। শরীর না থাকলে সত্যের অনুসন্ধান সম্ভব নয়।’ কিন্তু এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের মনকে সংযত করতে পারেন না। তাঁরা লোভ ক্রোধ ইত্যাদি রিপুর বশীভূত হয়ে ভিন্ন ধরনের শরীর লাভ করেন।
এই শরীরকে কখনও কখনও ‘ভোগায়তন’ অর্থাৎ ‘ভোগের স্থান’ বলে উল্লেখ করা হয়, কারণ দেহ ছাড়া আমরা বাসনা চরিতার্থ করতে পারি না। আমাদের মনে ভালমন্দ নানারকম আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। হয়তো কোন কারণে সেই বাসনা এই জীবনে অপূর্ণই থেকে গেল। কিন্তু যেহেতু সেই আকাঙ্ক্ষা মনে থেকেই যায়, পরজন্মে আবার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপযুক্ত শরীর লাভ হয়। উপনিষদ প্রকারান্তরে বলতে চাইছেন, ‘তুমিই তোমার ভাগ্যবিধাতা।’
পুনর্জন্মের এই ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেদান্তদর্শনে শরীরকে বলা হয়েছে ‘জলৌকাবৎ’ অর্থাৎ জোঁকের মতো। জোঁক যেমন গাছের এক পাতা থেকে আর এক পাতায় যায়, প্রাণও তেমনি এক দেহ থেকে অন্য দেহে যান। আমাদের কামনা-বাসনাই বারবার আমাদের এই জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।