তস্মৈ স হোবাচাকাশো হ বা এষ দেবো বায়ুরগ্নিরাপঃ পৃথিবী
বাঙ্মনশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ। তে প্রকাশ্যাভিবদন্তি বয়মেতদ্বাণমবষ্টভ্য
বিধারয়ামঃ॥২
অন্বয়: তস্মৈ (তাঁকে [ভার্গবকে]); সঃ হ উবাচ (তিনি [পিপ্পলাদ] বললেন); আকাশঃ এষঃ দেবঃ হ বৈ (আকাশই এই দেবতা); চ বায়ুঃ অগ্নিঃ আপঃ পৃথিবী (বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবীও); বাক্ (কথা এবং অন্যান্য কর্মেন্দ্রিয়); মনঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রং চ (মন, চোখ, কান এবং [অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহ]); প্রকাশ্য (তাদের নিজ শক্তি প্রকাশ করে); অভিবদন্তি (দর্পভরে বলা আরম্ভ করলেন); বয়ম্ এতৎ বাণম্ অবষ্টভ্য বিধারয়ামঃ (আমরাই দেহকে বলিষ্ঠ করি এবং ধারণও করি)।
সরলার্থ: পিপ্পলাদ ভৃগুপুত্রকে বললেন—আকাশই এই দেবতা। তেমনি বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক্, মন, চোখ এবং কানও দেবতা। তাঁরা সকলেই দর্পভরে নিজ নিজ ক্ষমতার কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের সকলের দাবি তাঁরাই দেহকে বলিষ্ঠ করেছেন এবং দেহকে ধারণও করে আছেন।
ব্যাখ্যা: এখানে দেহকে ‘বাণম্’ বলা হয়েছে কারণ দেহ চিরস্থায়ী নয়। কর্ম শেষ হলে দেহের বিনাশ হয়। আচার্য শঙ্করের মতে, এই দেহ কার্য-কারণের ফল। কারণ ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়। অতএব এই দেহ কর্মেরই ফল। যখন আমাদের কর্ম নিঃশেষ হয়, তখন দেহেরও অবসান হয়।
হিন্দুমতে, এই দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত : যথা আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল এবং পৃথিবী। আমাদের কর্মেন্দ্রিয় এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ও এই একই উপাদানে তৈরী। কর্মেন্দ্রিয় হল যথাক্রমে বাক্-বাগিন্দ্রিয়, পাণি—দুই হাত, পাদ—দুই পা, পায়ু—মলমূত্রদ্বার; উপস্থ—জননেন্দ্রিয়। আর জ্ঞানেন্দ্রিয় হল শ্রোত্র—কান, ত্বক—স্পর্শেন্দ্রিয়, চক্ষু—চোখ, জিহ্বা—জিভ, নাসিকা—নাক। এছাড়া আর একটি ইন্দ্রিয় আছে, তা হল মন। আর সবশেষে হল প্রাণ বা জীবনীশক্তি। প্রাণই প্রধানতম, সব কিছুর উৎস। মৃত্যু হলে আমাদের দেহ এবং ইন্দ্রিয় অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু তথাপি আমরা মৃত কারণ জীবনীশক্তি বা প্রাণ এই দেহ ত্যাগ করে গেছে।
এই ইন্দ্রিয়গুলিকে অনেকসময় দেবম্ বা দেবতা বলা হয়। ‘দেব’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যা প্রকাশ করে’। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের কাছে প্রকাশ করে। যেমন, জল ঠাণ্ডা না গরম তা আমরা স্পর্শ করে অর্থাৎ ত্বক দিয়ে বুঝতে পারি। আবার দেহের প্রতিটি উপাদানের এবং প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরও এক একটি দেবতা রয়েছেন।
পিপ্পলাদ এখানে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটি কাহিনী বলছেন। একদা দেবতাদের (ইন্দ্রিয়সমূহের) মধ্যে বিবাদ শুরু হল। নির্বোধের মতো তাঁরা ভাবলেন তাঁরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র। এই নিয়ে তাঁরা দম্ভ প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন: ‘এই দেহ আমরাই ধারণ করি। দেহ সহজেই নষ্ট হয়ে যায়; কাজেই মাঝখানে থেকে আমরা একে একত্র রাখি।’ ইন্দ্রিয়দের ধারণা প্রাসাদ যেমন বড় বড় স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনিভাবে তাঁরাও এই দেহকে ধারণ করে আছেন। তাঁরা বলতে চাইছেন : ‘আমরা যদি সরে যাই এই দেহের পতন ঘটবে।’