সংবৎসরো বৈ প্রজাপতিস্তস্যায়নে দক্ষিণং চোত্তরং চ।
তদ্যে হ বৈ তদিষ্ঠাপূর্তে কৃতমিত্যুপাসতে তে চান্দ্রমসমেব পোকমভিজয়ন্তে।
ত এব পুনরাবর্তন্তে তস্মাদেত ঋষয়ঃ প্ৰজাকামা দক্ষিণং প্রতিপদ্যন্তে।
এষ হ বৈ রয়িৰ্যঃ পিতৃযাণঃ॥৯
অন্বয়: সংবৎসরঃ বৈ প্রজাপতিঃ (প্রাণিকুলের প্রভুই সংবৎসর); তস্য দক্ষিণং চ উত্তরং চ অয়নে (তিনি দক্ষিণ এবং উত্তর, এই দুই পথে যাওয়া আসা করেন); তৎ (সেই কারণে); যে হ বৈ (যাঁরা); ইষ্টাপূর্তে ইতি (বিধিমতে বৈদিক যাগযজ্ঞ [ইষ্ট] এবং লোকহিতকর কর্ম [পূর্ত] যেমন কূপ খনন ইত্যাদি); কৃতং তৎ (‘এসব আমার করা হয়েছে’); উপাসতে (তিনি সবসময় এই প্রকার কর্মরত [এবং তিনি সর্বদা সচেতন যে তিনি এইসব কর্ম করছেন]); তে চান্দ্রমসম্ এব লোকম্ অভিজয়ন্তে (এরকম ব্যক্তি চন্দ্রলোক লাভ করেন); তে পুনঃ আবর্তন্তে এব (তাঁরা এই জগতে [মর্তে] আবার ফিরে আসেন); তস্মাৎ (সেই কারণে); এতে প্ৰজাকামাঃ ঋষয়ঃ (এই ঋষিগণ যাঁরা কোন ফললাভের আশায় [যেমন সন্তান কামনায়] বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করেন); দক্ষিণং প্রতিপদ্যন্তে (দক্ষিণদিকে গমন করেন); যঃ পিতৃযানঃ (পিতৃলোকের পথ); এষঃ হ বৈ রয়িঃ (এই হল চন্দ্র [খাদ্য])।
সরলার্থ: প্রজাপতি স্বয়ং সংবৎসর; তিনিই সৃষ্টিকর্তা। দুই পথে তাঁর আসা-যাওয়া—দক্ষিণ এবং উত্তর। এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বৈদিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান এবং লোকহিতকর কর্মে সবসময় ব্যস্ত। তাঁরা এ ধরনের কর্ম করতে গর্ব বোধ করেন। মৃত্যুর পর এই শ্রেণীর মানুষ চন্দ্রলোকে যান। কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য। আবার তাঁদের এই মর্তজগতে ফিরে আসতে হয়। সেইজন্যই সন্তান কামনায় যাঁরা যাগযজ্ঞ করেন তাঁরা দক্ষিণপথে যান। এই পথ পিতৃলোকের পথ, এই পথই রয়ি।
ব্যাখ্যা: সাধারণভাবে মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীর মানুষের কাছে জীবনের অর্থ গভীর। তাঁরা জ্ঞানলাভ করতে চান। জানতে চান সত্য কি, মানুষের স্বরূপ কি, এবং কোথা থেকে তাঁরা এসেছেন। এই শ্রেণীর মানুষ আত্মসংযম অভ্যাস করেন, ঈশ্বরচিন্তা করেন এবং নানা গুণাবলী আয়ত্ত করার চেষ্টা করেন। আবার অপর শ্রেণীর লোকদের ধারণা মানবজীবন শুধুই ভোগের জন্য। তাঁরা কেবলমাত্র ভোগেই মত্ত থাকতে চান। কিন্তু একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন তাঁদেরও মৃত্যু অনিবার্য। যদি ভাল কাজ করে সাধুজীবন যাপন করতে পারেন, তাহলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হবে এবং সেখানেও সুখভোগ করতে পারবেন।
এই দুই শ্রেণীর মানুষ একই ধরনের কাজ করতে পারেন, কিন্তু দুয়ের মধ্যে পার্থক্যটা একেবারে গোড়ায়। যিনি জ্ঞানলাভ করতে চান, জাগতিক ভোগসুখকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করেন। কিন্তু যাঁরা বিষয়সুখে আসক্ত তাঁদের জ্ঞানলাভের ইচ্ছাই হয় না। বিষয়ী মানুষ সৎকর্ম করলেও তা করেন ইহকাল বা পরকালে কিছু পুরস্কার লাভের আশায় (সকাম কর্ম)।
যিনি প্রকৃতই আত্মজ্ঞান লাভ করতে চান, কোন অনিত্য বস্তু তাঁকে তৃপ্ত করতে পারে না। নিত্যকে লাভ করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। নিজের জন্য কোনরকম ফলের আশা না করে তিনি সব কর্ম করেন। যা কিছু তিনি করেন তা ঈশ্বরার্থ অর্থাৎ ঈশ্বরের উদ্দেশে অথবা লোকহিতার্থ অর্থাৎ লোককল্যাণের জন্য। তাঁর কাছে কর্মই উপাসনা। সমাজ তাঁকে স্বীকৃতি দিল কিনা, সংবাদপত্রে তাঁর নাম বেরোল কিনা, ঈশ্বর তাঁকে পুরস্কার দেবেন কিনা এসব নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন। তিনি ভাল কাজ করেন কারণ তিনি ভাল কাজ করতে ভালবাসেন।
অতএব উপনিষদ বলেন—যেমন এই দুই শ্রেণীর মানুষ আছেন তেমনি পথও দুটি। একটি দক্ষিণায়ন, অপরটি উত্তরায়ণ। সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে থাকে তখন দক্ষিণায়ন। একে চন্দ্রের পথও বলা হয়। আর সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে তখন তাকে বলে উত্তরায়ণ। এই পথ সূর্যের পথ। এখন উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন, এই যে দুভাগ করা হয়েছে এসবই রূপক অর্থে। উপনিষদে বলা হয়েছে—সময়ের এই যে বিভাগ তাও প্রজাপতি।
যাঁরা জ্ঞানলাভে ইচ্ছুক তাঁদের সূর্যের পথ অর্থাৎ জ্ঞানের পথই গ্রহণ করতে হবে। আলো জ্ঞানের প্রতীক। কাজেই প্রথম শ্রেণীর মানুষ যাঁরা জ্ঞানের পথে চলেন তাঁরা মৃত্যুর পর সেই জ্যোতির্লোকে যান বলে বিশ্বাস। কিন্তু যাঁরা ভোগবিলাসী, তাঁরা উপনিষদের মতে, চন্দ্রের পথ অনুসরণ করেন। চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। তাই তাকে অন্ধকারের প্রতীক বলে ধরা হয়।
অধিকাংশ মানুষই চন্দ্রের পথ বেছে নেন কারণ তাঁরা ভোগে আসক্ত। উপনিষদ বলেন—এঁরা দুরকমের কাজ করেন, ইষ্ট এবং পূর্ত। ইষ্ট অর্থ দৈনন্দিন অবশ্যকর্তব্য যেমন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ যা প্রাচীনকালে অনুষ্ঠিত হত এবং অতিথি সৎকার ও পশুপাখীর সেবা। সৎ হওয়ার চেষ্টাও এ জাতীয় কর্মের মধ্যেই পড়ে। আর ‘পূর্ত’ অর্থ লোককল্যাণের জন্য বিশেষ সেবাকর্মের অনুষ্ঠান যেমন কুয়ো বা পুকুর খনন, মন্দির নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ বা দরিদ্রকে বিনামূল্যে অন্নবিতরণের জন্য রন্ধনশালার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
এসব কর্ম অতি উত্তম সন্দেহ নেই। যাঁরা তা করেন তাঁদের উপনিষদ ঋষি আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে এ জাতীয় কর্ম করা অত্যন্ত কঠিন। প্রথমে মানুষের মধ্যে একটা গর্ববোধ আসে, ‘আমি এতসব কাজ করেছি’। অর্থাৎ মানুষ নামযশের আকাঙ্ক্ষা করে। এছাড়া সে নিজেকে কোন বিশেষ পুরস্কার যেমন সন্তান, বা ধনসম্পদ বা পরকালে স্বর্গলাভ ইত্যাদি পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করে।
তখন কি হয়? এই ব্যক্তি মৃত্যুর পরে চন্দ্রের পথ অনুসরণ করে। আগেই বলা হয়েছে চন্দ্রই অন্ন; চন্দ্র প্রাণকে ধারণ করে রাখে। চন্দ্র ভোগের প্রতীক। কাজেই মানুষ যখন চন্দ্রের পথ বা ‘দক্ষিণ’পথ অনুসরণ করে তখন সে পিতৃলোক বা চন্দ্রলোকে যায়। এই পথ অন্ধকারের পথ, অবিদ্যার পথ। সেখানে মানুষের কিছুদিন সুখভোগ হয় ঠিকই, কিন্তু তাকে আবার ফিরে আসতে হয়। পুণ্যকর্মের পুরস্কারও ক্ষণস্থায়ী। ভাল কাজের ফল যখন নিঃশেষ হয়ে আসে তখন এই পৃথিবীতে তাকে আবার ফিরে আসতে হয়।