তস্যৈ তপো দমঃ কর্মেতি প্রতিষ্ঠা বেদাঃ সর্বাঙ্গানি
সত্যমায়তনম্॥৮
অন্বয়: তস্যৈ [অর্থাৎ, তস্যঃ] (এই বিষয়ে [অর্থাৎ, ব্রহ্ম অথবা আত্মজ্ঞান]); তপঃ (কৃচ্ছ্রসাধন); দমঃ (আত্মনিগ্রহ); কর্ম (কাজ, আধ্যাত্মিক অনুশীলন); প্রতিষ্ঠা (ভিত্তি); বেদাঃ (বেদসমূহ); সর্বাঙ্গানি (সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ); সত্যম্ (সত্য); আয়তনম্ (আবাস)।
সরলার্থ: কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন, এই তিনটি হল আত্মজ্ঞানের ভিত্তি। বেদসমূহ এই জ্ঞানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং সত্য এই জ্ঞানের আবাস।
ব্যাখ্যা: উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মকে জানতে গেলে আমাদের কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মসংযম এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশাসনের অনুশীলন করতে হবে। কারণ এগুলিই আত্মজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা বা মূলভিত্তি। বেদ এই জ্ঞানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কারণ, বেদ পড়লে আমাদেব সংশয় দূর হয়ে যায়। আত্মসংযম, নিষ্কাম কর্ম, শাস্ত্রচর্চা—এগুলি সবই হচ্ছে উপায়, যার দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়, মনের পবিত্রতা আসে। যখন অহংবোধ চলে যায় এবং মন শুদ্ধ হয়, তখনই সাধক আত্মজ্ঞান লাভ করে।
সবথেকে প্রয়োজনীয় জিনিস হল সত্য। উপনিষদ বলছেন, আত্মজ্ঞানের নিবাস হল সত্য। সত্যের স্থান তাই সবার ওপরে। কেউ হয়তো সংযমী ও পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু সত্য ছাড়া আত্মজ্ঞান লাভ তাঁর পক্ষেও সম্ভব হবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বলেছিলেন, ‘জগৎ-জননীকে সবকিছু দিয়েছিলাম, শুধু সত্য দিতে পারিনি।’
এখন প্রশ্ন, সত্য কি? সত্য বলতে ঠিক কি বোঝায়? ‘অমায়িতা’, এবং ‘বাঙ্মনঃকায়ানাম্ অকুটিল্যম্’—এই হচ্ছে সত্যের উপাদান। সহজ করে বললে বলতে হয়, সত্য হচ্ছে চিন্তা, কথা ও কাজে সরলতা, সততা ও আন্তরিকতা। মন, মুখ এক করতে হবে; কথা ও কাজে সঙ্গতি আনতে হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, সত্য কথাই কলির তপস্যা, শ্রেষ্ঠ সাধন। তিনি বলতেন, আমাদের চিন্তা, কথা এবং কাজে যেন মিল থাকে। বস্তুত সত্যিকারের সৎ মানুষ কখনও সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না। তিনি যা বলেন তাই সত্য হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের জীবনে এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে গেছেন। যদি তিনি একবার বলতেন যে, এই কাজটা করব, তাহলে যত বাধাবিঘ্নই আসুক না কেন তিনি তা করতেন। অন্যদেরও তিনি সেই শিক্ষাই দিতেন এবং যাতে তাঁরা কঠোরভাবে সত্য পালন করেন সেদিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। ‘করব’ বলে কেউ যদি সেই কাজটা না করতেন, কিংবা ঠাট্টার ছলেও কেউ অসত্য কথা বলতেন, তাহলে তাতে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হতেন। সাধারণ মানুষ বলে, সততাই শ্রেষ্ঠ পথ। গান্ধীজী আরও একধাপ এগিয়ে বলতেন, সততাই একমাত্র পথ।