ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি
ন চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টিঃ।
ভূতেষু ভূতেষু বিচিত্য ধীরাঃ
প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি॥৫
অন্বয়: ইহ (এখানে [অর্থাৎ এই জীবনে]); চেৎ (যদি); অবেদীৎ (কেউ জানেন [অর্থাৎ আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানেন]); অথ (তাহলে); সত্যম্ (সত্য, পরম সত্য); ন চেৎ ইহ অবেদীৎ (যদি কেউ এই পরম সত্য না জানেন); অস্তি (বর্তমান, আছে); মহতী বিনষ্টিঃ (অশেষ যন্ত্রণা); ভূতেষু ভূতেষু (সর্ববস্তুতে এবং সর্বজীবে [অর্থাৎ সর্বত্র]); বিচিত্য (জেনে [ব্রহ্ম সর্বত্র আছেন জেনে]); ধীরাঃ (জ্ঞানীরা, বিচারশীল ব্যক্তিরা); প্ৰেত্য (প্রত্যাহার করে, ত্যাগ করে); অস্মাৎ লোকাৎ (এই জগৎ থেকে); অমৃতাঃ ভবন্তি (অমর হন)।
সরলার্থ: কেউ যদি এ জীবনেই আত্মাকে ব্রহ্মরূপে জানতে পারেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হন। এই জ্ঞান ছাড়া অশেষ দুঃখভোগ অনিবার্য। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যিনি এই সত্য জানেন যে, ব্রহ্ম সকল বস্তু ও সকল জীবের মধ্যে অনুস্যূত হয়ে আছেন, তিনি নিজেকে এই জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং মুক্ত হয়ে যান।
ব্যাখ্যা: এখানে সার কথাটা হল—এই জীবনেই আত্মজ্ঞান সম্ভব, কিন্তু একমাত্র মনুষ্য শরীরেই তা সম্ভব। কারণ মানুষ চিন্তা করতে পারে, বিচার করতে পারে, জীবনের একটা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে নিয়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য সংগ্রাম করতে পারে। পশুর পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাজেই মনুষ্যজন্ম লাভ করেও যদি আমরা আত্মজ্ঞান অর্জনের জন্য চেষ্টা না করি, তবে তার মতো ক্ষতি আর হয় না। এই উপনিষদ তাই সাবধান করে দিয়ে বলছেন, আত্মজ্ঞান লাভের উদ্যোগ না করলে আমাদের অশেষ দুঃখদুর্দশা ভোগ করতে হবে। কখনও ভাল, কখনও মন্দ অবস্থার শিকার হয়ে জন্মমৃত্যুর আবর্তে বারবার ঘুরপাক খেতে হবে।
মজার কথা হল আমরা অমর হয়েই আছি। এই নয় যে, আমাদের অমর হতে হবে, বা একটা উচ্চতর অবস্থায় আমরা উঠছি। না, তা নয়। আমরা প্রথম থেকেই ব্রহ্ম, তাই আমাদের মৃত্যু নেই। আমরা অমর। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক এ সত্য আমরা জানি না। একটা অবগুণ্ঠন আমাদের স্বরূপ বা প্রকৃত পরিচয়টি ঢেকে রেখেছে। আমাদের কাজ হল এই আবরণটিকে সরানো।
যিনি জ্ঞানী, তিনি ‘ভূতেষু ভূতেষু’ অর্থাৎ, পুরুষ, স্ত্রী, জীবজন্তু, এককথায় সর্বভূতে নিজের আত্মাকে দেখেন। যখন কেউ নিজের মধ্যে সবাইকে ও সবকিছুকে এবং সকলের মধ্যে নিজেকে দেখেন (অর্থাৎ, এক সত্তা বা একত্ব অনুভব করেন), তখন তিনি সকলকে না ভালবেসে পারেন না। তখন কেউই তাঁর পর নন। শোনা যায় বিখ্যাত বেদান্তবাদী রামতীর্থ কোন বক্তৃতা দিতে গেলে শ্রোতাদের এই বলে সম্বোধন করতেন—‘আমি, যে আমি সমবেত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহোদয়া সকলের মধ্যে বিরাজমান’। ভাবটা হল এই যে, আমার আত্মাই সকলের আত্মা যিনি সর্বত্র বিরাজ করছেন। যিনি বলছেন আর যাঁরা শুনছেন, সবাই সেই এক এবং অভিন্ন আত্মা। যেন আত্মায় আত্মায় কথা হচ্ছে। তফাৎ শুধু নাম আর রূপের। অস্তিত্বের এই একত্ব, এই ঐক্যই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আমরা সকলে এক। পার্থক্য কেবলমাত্র প্রকাশের তারতম্যে।
কেন উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ড এইখানে সমাপ্ত।