যদ্বাচাঽনভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে।
তদেব ব্ৰহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে॥৫
অন্বয়: যৎ (যিনি); বাচা (বাক্যের দ্বারা); অনভ্যুদিতম্ (অপ্রকাশিত); যেন (যাঁর দ্বারা); বাক্ (বাক্য); অভ্যুদ্যতে (স্ফূর্ত হয়, প্রকাশের মাধ্যম হয়); তৎ এব ব্রহ্ম (তিনিই নিশ্চিত ব্রহ্ম); ত্বং বিদ্ধি (তুমি জানো); ন ইদম্ (এঁকে নয়); যৎ ইদম্ উপাসতে (যাঁকে লোক পূজা করে)।
সরলার্থ: একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে বাক্য দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, বরং যাঁর দ্বারা বাক্যই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্ম বা আত্মাকে কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কেন যায় না? কারণ আত্মাই বাক্যকে প্রকাশ করে। আত্মা না থাকলে বাক্যের অস্তিত্বই অসম্ভব। তাই কেন উপনিষদের শুরু হয়েছে এই প্রশ্নটি দিয়ে—‘এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, দৃশ্যমান জগতের পেছনে কে আছেন?’ এই বাহ্যজগৎ আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। মন ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপেও আমরা চমৎকৃত। তাই আমরা প্রশ্ন করি—‘এসবের নেপথ্যে কে বা কোন্ শক্তি কাজ করছে?’ বিজ্ঞানীরা কখনও কখনও বলেন, যদি স্রষ্টা বলে কেউ একজন থাকেন তবে তিনি অবশ্যই একজন মস্ত গণিতজ্ঞ, কারণ জগতের সমস্ত কিছুই অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, অঙ্কের মতো নিখুঁত। আবার অন্য কেউ কেউ বলেন, জগৎ-স্রষ্টা একজন অসাধারণ এঞ্জিনীয়ার। বাস্তবিক এই জগতের সবকিছুই এমন নিখুঁত ছন্দে চলছে যে সময়ে সময়ে আমরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, কার জন্যে এটা সম্ভব হচ্ছে? তার উত্তর এই—ব্রহ্মের জন্যেই এইসব সম্ভব হচ্ছে। এই উপনিষদ সেই ব্রহ্মকে জানার জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে বলছেন।
এই দৃশ্যমান স্থূলজগৎ আমাদের কাছে অত্যন্ত সত্য বলে মনে হয়। তাই আমরা জাগতিক ভোগসুখের পেছনে মোহগ্রস্তের মতো ছুটে চলি। জগতে যত ভোগের বস্তু, বস্তুত আমরা যেন তারই পুজো করি। কিন্তু আমাদের জানা উচিত যে, এই জগৎ অসার, অনিত্য; এর কোন পারমার্থিক সত্তা নেই। পার্থিব বস্তুর পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা অনিত্য বস্তুর পেছনে ছুটে বেড়াই। আর তার জন্যই আমাদের যত কষ্ট, যত জ্বালা-যন্ত্রণা। এই দৃশ্যমান জগতের নেপথ্যে রয়েছেন সেই পরম সত্য, ব্রহ্ম, যাঁর সঙ্গে আমরা অভিন্ন। অজ্ঞানতার মোহজাল ছিঁড়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, এবং ব্রহ্মোপলব্ধির জন্য সচেষ্ট হতে হবে।