অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽসম্ভূতিমুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ॥১২
অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ।
ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে॥১৩
সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বাঽসম্ভূত্যাঽমৃতমশ্নুতে॥১৪
অন্বয়: যে অসম্ভূতিম্ (যাঁরা অব্যক্তকে); উপাসতে (উপাসনা করেন); অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি (অন্ধকার লোকে প্রবেশ করেন, যেখানে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে অন্ধ); যে সম্ভূত্যাং রতাঃ (যাঁরা ব্যক্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন); ততঃ ভূয়ঃ ইব তে তমঃ (তার ফলে তাঁরা যেন আরও বেশী অন্ধকারে); প্রবিশন্তি (প্রবেশ করেন)। সম্ভবাৎ (ব্যক্তপ্রকৃতি থেকে, হিরণ্যগর্ভ থেকে); অন্যৎ এব (ভিন্ন [ফল]); আহুঃ (পণ্ডিতেরা বলেন); অসম্ভবাৎ (অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে); অন্যৎ (অন্য, অন্য প্রকার ফল); আহুঃ (পণ্ডিতেরা বলেন); ইতি (এই); শুশ্রুম.(আমরা শুনেছি); ধীরাণাম্ (জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে); যে (যাঁরা); নঃ (আমাদেরকে); তৎ (প্রকৃতি বা হিরণ্যগর্ভকে উপাসনার ফল); বিচচক্ষিরে (ব্যাখ্যা করেছেন)। সম্ভূতিং চ বিনাশং চ (অব্যক্ত প্রকৃতি এবং ব্যক্ত প্রকৃতি [হিরণ্যগর্ভ]); যঃ তৎ উভয়ং সহ বেদ (যিনি উভয়কে জানেন); বিনাশেন (ব্যক্তের, হিরণ্যগর্ভের উপাসনার দ্বারা); মৃত্যুম্ (মৃত্যুকে); তীর্ত্বা (অতিক্রম করে); অসম্ভূত্যা (অব্যক্তের উপাসনার দ্বারা); অমৃতম্ (অমরত্ব); অশ্নুতে (লাভ করেন)।
সরলার্থ: যাঁরা অব্যক্তকে (জগতের কারণ অবস্থা) উপাসনা করেন তাঁরা অন্ধের মতো অন্ধকারে প্রবেশ করেন। কিন্তু যাঁরা ব্যক্তকে (অর্থাৎ চতুর্দিকের দৃশ্যজগৎ) উপাসনা করেন তাঁরা আরো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেন।
পণ্ডিতেরা বলেন সম্ভূতির (হিরণ্যগর্ভ) এবং অসম্ভূতির (প্রকৃতি) উপাসনা পৃথক পৃথক ফল দান করে। জ্ঞানীরা তা সমর্থন করেন।
যিনি অব্যক্তকে (অসম্ভূতি) এবং ব্যক্তকে (সম্ভূতি) একই সঙ্গে উপাসনা করেন তিনি অব্যক্তের উপাসনা দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করেন এবং ব্যক্তের উপাসনা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করেন।
ব্যাখ্যা (Verse 12): অসম্ভূতি—অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত। সম্ভূতি—ব্যক্ত বা প্রকাশিত। ভারতীয় দর্শন সৃষ্টি তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। অর্থাৎ শূন্য থেকে ‘কিছু’ সৃষ্টি হয় একথা ভারতীয় দর্শন স্বীকার করে না। কার্য থাকলে অবশ্যই তার পূর্বে কারণ থাকবে। কারণ দেখা না গেলেও তার অস্তিত্ব কোন না কোন সময়ে থাকবেই। যেমন একটি বিশাল বটগাছ। কোথা থেকে এই গাছটির জন্ম হল? মাটির নীচে নিহিত কোন বীজ থেকে। বীজটিকে আমরা দেখতে পাই না কিন্তু নিশ্চয়ই বীজটি কোথাও না কোথাও ছিল। বীজ ছিল না, একথা বলা যায় না। পূর্বে গাছটি বীজরূপে অব্যক্তভাবে ছিল। এখন গাছ রূপে প্রকাশিত হল। আমাদের চারপাশে যা দেখি—গাছ, আকাশ, পর্বত, সমতল, নদী, অরণ্য, মানুষ, পশু—সব এককালে অব্যক্ত অবস্থায় অর্থাৎ অসম্ভূতির অংশ রূপে ছিল। ‘অসম্ভূতি’ এবং প্রকৃতি একই। এ এমন অবস্থা যখন সব শক্তিগুলি একে অপরের সঙ্গে সাম্য অবস্থায় থাকে। ভারতীয় দর্শন প্রধানত সত্ত্ব, রজ, তম—এই তিনটি শক্তির উল্লেখ করেছেন। যখন এই তিনটি শক্তি সাম্য অবস্থায় থাকে অর্থাৎ তিনটিই সমানভাবে থাকে, তখন কোন প্রকাশ থাকে না। তখনকার অবস্থা বর্ণনা করা কঠিন। এ এক অনির্দিষ্ট সত্তা—যেন তরঙ্গবিহীন সমুদ্র যা অনন্ত, এক ও অভেদ।
কিন্তু কোন ভাবে কোন একসময় এই সাম্য অবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। কেন ঘটে কেউ জানে না। সম্ভবত বস্তুর প্রকৃতিগত কারণেই এই বিক্ষেপের সৃষ্টি হয়। এখানেই ‘সম্ভূতি’ বা প্রকাশের সূত্রপাত। এক বহুতে পরিণত হয়। বহু একে নিহিত ছিল। এবারে তা প্রকাশ পেল। প্রথম প্রকাশকে বলা হয় হিরণ্যগর্ভ অথবা ‘প্রথমজাত’।
‘অসম্ভূতি’ বা ‘সম্ভূতি’—যারই উপাসনা করা যাক না কেন ফল কিন্তু একই। এ যেন অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ানো। ‘অসম্ভূতি’ সম্পর্কে কিছু না জেনেও তাকে উপাসনা করা যায়। হয়তো ভয় থেকে অথবা কিছু পাওয়ার আশা করে এই উপাসনা করা হয়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ অন্ধ, অসহায় এবং অজানা আশঙ্কায় ভীত।
‘সম্ভূতি’ বা ব্যক্ত জগতের উপাসনা আরও নিকৃষ্ট কারণ সেখানে এমন কিছু জিনিস আছে যা ভীতিপ্রদ, আবার এমনও আছে যা লোভনীয়। কিন্তু এর কোনটিই পরিণামে সুখের নয়। মানুষ এখানে অসহায় ক্রীতদাস মাত্র। এই অবস্থাকে বোঝাবার জন্যই বলা হয়েছে সম্ভূতির উপাসনা আমাদেরকে গভীরতর অন্ধকারে নিয়ে যায়।
কিন্তু বেদান্ত বলেন, বাইরে কিছু নয় সবই তোমার ভেতরে আছে। তোমার আত্মাই সর্বোচ্চ। বাইরের কোন বস্তুর দাসত্ব স্বীকার করলে কখনও সুখী হওয়া যায় না। নিজেকেই নিজের প্রভু হতে হবে, এই বেদান্তের বক্তব্য।
ব্যাখ্যা (Verse 13): ব্যক্ত এবং অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা করা যে নিরর্থক আচার্য শঙ্কর তা পূর্বেই বলেছেন। ব্যক্ত প্রকৃতিকে (হিরণ্যগর্ভ) উপাসনা করে আমরা বড় জোর কিছু অসামান্য শক্তি লাভ করতে পারি। প্রকৃতির কার্যকলাপ অতি বিস্ময়কর। প্রকৃতিকে উপাসনা করে প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য বিভূতির কিছুটা হয়তো আমাদের মধ্যে আসতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা করে আমরাও অব্যক্ত হয়ে যাই। অব্যক্ত প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যাই। হিন্দুদের বিশ্বাস, আমরা যার উপাসনা করি তাই হয়ে যাই।
ব্যাখ্যা (Verse 14): প্রথম ‘সম্ভূতি’কে ‘অসম্ভূতি’ বলে পাঠ করতে হবে—অর্থাৎ অব্যক্ত। ‘অ’ এখানে ছন্দের কারণে অনুক্ত। বিনাশ বা মৃত্যু হল হিরণ্যগর্ভ, যা সম্ভূতির প্রথম প্রকাশ। হিরণ্যগর্ভের নাম বিনাশ কারণ একসময় পুরোপুরি তার লয় হবে। যা ব্যক্ত তাই পুনরায় অব্যক্তে পরিণত হতে পারে।
পরমসত্য, ব্যক্ত এবং অব্যক্ত দুই-ই হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে সত্য এক এবং অদ্বিতীয়, তা ব্যক্ত বা অব্যক্ত যাই হোক না কেন। যদি আমরা আমাদের উপাসনা ব্যক্ত বা সম্ভূতি বা হিরণ্যগর্ভ দিয়ে শুরু করি, তবে আমরা কিছু অলৌকিক শক্তির অধিকারী হতে পারি। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে মানুষ কি না করতে পারে। মানুষ জীবনের অনেক সীমাবদ্ধতাকেই অতিক্রম করতে পারে, এমনকি মৃত্যুভয়কেও জয় করতে পারে। যদি আমরা হিরণ্যগর্ভের উপাসনা করি তাহলে আমরা তাঁর মতোই হয়ে যাব। হিরণ্যগর্ভ মৃত্যুর অধীন। কারণ যার উৎপত্তি আছে তার লয়ও আছে। এর থেকে আমরা শিক্ষা পাই মৃত্যুই শেষ নয়, এ একটা অবস্থান্তর মাত্র। যখন আমরা তা.হৃদয়ঙ্গম করি তখন আমাদের অমরত্ব সম্বন্ধে ধারণা হয় এবং আমরা মৃত্যুকে জয় করি।
অব্যক্তের উপাসনাতেও আমাদের অনুরাগী হতে হবে। যখন আমরা অব্যক্তকে ভালবাসতে শিখি তখন আমরা অব্যক্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। অব্যক্তই প্রকৃতি এবং প্রকৃতিই চিরন্তন। এভাবে আমরাও চিরন্তন হয়ে উঠি। সম্ভূতি, অসম্ভূতি উভয়ই আমাদের অমরত্বের বোধ এনে দিতে পারে, কিন্তু সেই অমরত্ব আপেক্ষিক। কেবলমাত্র আত্মজ্ঞান লাভ হলে মৃত্যুকে সম্পূর্ণ জয় করা সম্ভব হয়।
বিদ্যা, অবিদ্যা, সম্ভূতি, অসম্ভূতি—এ সবই অজ্ঞানতার এলাকার মধ্যে পড়ে।
এ সব আমাদের কিছুকালের জন্য মুক্তির স্বাদ দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু তা স্থায়ী মুক্তি নয়। আমরা তখনও কর্মপাশে আবদ্ধ।