অনেজদেকং মনসো জবীয়ো
নৈনদ্দেবা আপ্লুবন্ পূর্বমর্ষৎ।
তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ
তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি॥৪
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ॥৫
অন্বয়: অনেজৎ (নিষ্কম্প); একম্ (এক); মনসঃ (মনের চেয়ে); জবীয়ঃ (বেশী বেগবান); দেবাঃ (ইন্দ্রিয়সমূহ); পূর্বম্ অর্ষৎ (সকলের আগে); এনৎ ন আপ্লুবন্ (এঁর নাগাল পায় না); তৎ (তিনি); তিষ্ঠৎ (স্থির থেকে); ধাবতঃ (চলমান); অন্যান্ (অন্য সকলকে); অতি এতি (অতিক্রম করে যান); তস্মিন্ (তিনি আছেন বলে); মাতরিশ্বা (বায়ু অর্থাৎ জগৎ বিধায়ক সূত্ৰাত্মা বা হিরণ্যগর্ভ); অপঃ (জল অর্থাৎ কর্মসমূহ); দধাতি (বিশেষরূপে পালন করেন)। তৎ (তিনি); এজতি (চলেন); তৎ (তিনি); ন এজতি (চলেন না); তৎ (তিনি); দূরে (দূরে); তৎ (তিনি); উ অন্তিকে (কাছেও); তৎ (তিনি); অন্তঃ (ভিতরে); অস্য সর্বস্য (এর অর্থাৎ জগতের); তৎ (তিনি); উ (আবার); অস্য (এর); সর্বস্য (সকলের); বাহ্যতঃ (বাইরে)।
সরলার্থ: ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। ব্রহ্ম একাধারে স্থির, আবার অপর দিকে চঞ্চল, মন অপেক্ষাও দ্রুতগামী। তিনি সব সময়ই সবার আগে রয়েছেন। ইন্দ্রিয়সমূহও এঁর নাগাল পায় না। তিনি নিজে স্থির থেকেও অন্য সকলকে অতিক্রম করে যান। শূন্যের দেবতা হিরণ্যগর্ভরূপে তিনি এই স্থূল ও দৃশ্যমান জগতের সবকিছুকে ধরে রেখেছেন।
তিনি (ব্রহ্ম) সচল হয়েও স্থির। তিনি দূরেও আছেন আবার কাছেও আছেন। তিনি (ব্রহ্ম) সব কিছুর ভেতরেও আছেন আবার সব কিছুর বাইরেও আছেন।
ব্যাখ্যা (Verse 4): ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। ব্ৰহ্ম স্বয়ংসম্পূর্ণ। ব্রহ্ম অচঞ্চল, সতত স্থির এবং অপরিবর্তিত। আবার মন অপেক্ষাও তিনি দ্রুতগামী। তিনি আছেন বলেই জগতের সব কিছু আছে, এবং তিনিই জগতের সব কিছুকে চালনা করেন। তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা মাতরিশ্বাকে শক্তি দান করেন। এই মাতরিশ্বার (যাঁর বাস অন্তরীক্ষে) দ্বারাই জগতে কার্য-কারণ ইত্যাদি সক্রিয় থাকে।
ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায় না। তিনি বাক্য ও মনের অতীত। তিনি সর্বত্র এবং সর্ববস্তুতে বিরাজিত। তিনি নিরাকার, আবার তিনিই সাকার। তাঁর কোন নাম নেই আবার সব নামই তাঁর নাম। বস্তুত তিনি অনন্য। এই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেবার জন্যই উপনিষদ পরস্পরবিরোধী উক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। একবার বলা হচ্ছে ব্রহ্ম স্থির, ঠিক পরের মুহূর্তেই বলা হচ্ছে মন অপেক্ষাও ইনি দ্রুতগামী। এ কথার অর্থ কি?
এর উত্তর হল: ব্রহ্মের দুটি দিক আছে। একদিকে তিনি নির্গুণ। তিনি পরম। তিনি শুদ্ধ চৈতন্য। তিনি সচ্চিদানন্দ। তিনিই পরমাত্মা।
অপরদিকে ব্রহ্ম সগুণ। এটি ব্রহ্মের আপেক্ষিক দিক। এই দিক থেকে বলা যায়, তিনি সাকার, তিনি সগুণ; ভালমন্দ ছোটবড় সবই তিনি। এইসব গুণের পার্থক্যে তাঁর কোন শেষ নেই। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এগুলি আত্মার ওপর আরোপিত গুণ বা উপাধি (অধ্যাস) মাত্র। এই গুণসকল ব্রহ্মকে স্পর্শ করতে পারে না। শিশুরা যে মুখোশ পরে এই গুণগুলিও অনেকটা সেই মুখোশের মতো।
মন নিজে নিষ্ক্রিয়। মন তখনই সক্রিয় হয় যখন আত্মা (ব্রহ্মেরই অপর নাম) তাতে প্রাণসঞ্চার করে। মন আত্মা অপেক্ষা দ্রুতগামী নয়। কারণ আত্মাই তাকে সচল করে তোলে এবং সেই আত্মা সর্বত্র বিরাজমান। শুধু মনেই নয় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের (এগুলিকে দেব বলা হয়, কারণ এগুলি ব্যক্ত) বেলাতে এবং প্রকৃতির সব উপাদান সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। এই শক্তিই সকল কার্য ও কারণের পেছনে কাজ করে থাকে।
এক্ষেত্রে বায়ুর দৃষ্টান্ত খুবই প্রাসঙ্গিক। বায়ু যখন আত্মার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন বায়ুই জীবনীশক্তি, কিন্তু আলাদাভাবে বায়ু জীবনকে রক্ষা করতে পারে না। বায়ুকে মাতরিশ্বা বলা হয়। কারণ তা অন্তরীক্ষে অর্থাৎ শূন্যে (মাতরি) চলমান (শ্বা)। কিন্তু পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন তিনি হিরণ্যগর্ভ (ব্যষ্টি হিসাবে ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ) অথবা সূত্ৰাত্মা (মালায় যেমন নানা ফুল এক সুতোতে গাঁথা থাকে, ‘সূত্রে মণিগণা ইব’)। এই ভাবে ব্রহ্ম এই দৃশ্য জগতের সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন—‘এঁর ভয়ে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়, সূর্য আলো দান করে, ইন্দ্র, বায়ু, মৃত্যু বা পঞ্চম ক্রিয়াশীল হয়।’
ব্রহ্ম ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। কিন্তু কোন কিছুর দ্বারা ব্রহ্ম প্রভাবিত নন। এই দৃশ্যজগৎ ব্রহ্ম থেকেই এসেছে, ব্রহ্মেই স্থিত, আবার ব্রহ্মেই ফিরে যায়।
ব্যাখ্যা (Verse 5): ব্রহ্মকে বর্ণনা করার চেষ্টা যে কত বৃথা, এই মন্ত্রে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ব্রহ্ম নামরূপহীন। কোন বিশেষণ দ্বারা ব্রহ্মকে বিশেষিত করা যায় না। তিনি কিছু না হয়েও সব হয়েছেন। তিনি কিছু নন, কারণ তিনি বাক্যমনাতীত। তিনি সবকিছু কেননা সবকিছু তাঁরই ওপর ন্যস্ত। তিনি আছেন বলেই সব কিছু আছে। সব অস্তিত্বের সারাৎসারও তিনি। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, কিন্তু নাম রূপের পার্থক্যের জন্য তিনিই আবার বহু হয়েছেন। এই নাম এবং রূপ ব্রহ্মের ওপর আরোপিত মাত্র। তিনি অপরিবর্তিত এবং অপরিবর্তনীয়। তিনি কোন কিছুর অধীন নন অর্থাৎ স্বাধীন। তিনি একইসঙ্গে সকলের অন্তরে আছেন, আবার বাইরেও আছেন।
স্বরূপত ব্রহ্ম নিশ্চল এবং পরিবর্তনরহিত। তিনি সতত বিদ্যমান। কখনও কখনও মেঘের আড়ালে চাঁদকে গতিশীল বলে আমাদের মনে হয়। আসলে এ গতি চাঁদের নয়, মেঘের। সেইভাবে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা সর্বদা এক এবং অপরিবর্তিত। তাঁর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। কিন্তু আত্মা যেহেতু দেহের সাথে যুক্ত তাই মনে হয় দেহের মতো আত্মারও জন্ম মৃত্যু ঘটে। আমরা নূতন কাপড় পরে থাকি, কিন্তু সে কাপড় যখন ছিঁড়ে যায় তখন আমরা তাকে ত্যাগ করি। কাপড়ের সঙ্গে দেহের যেরকম সম্পর্ক আত্মার সঙ্গেও দেহের সম্পর্ক সেইরূপ।