ওঁ ঈশাবাস্যমিদং সর্বং
যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা
মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্॥১
অন্বয়: জগত্যাম্ (জগতে); যৎ কিঞ্চ (যা কিছু); জগৎ (পরিবর্তনশীল, বিনাশশীল); ইদং সর্বম্ (এই সবকিছু); ঈশা বাস্যম্ (ঈশ্বর কর্তৃক আচ্ছাদিত); তেন (সেই হেতু); ত্যক্তেন (ত্যাগের দ্বারা); ভুঞ্জীথা (পালন কর [অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বত্র এবং সর্বভূতে আছেন এই চেতনাকে বলিষ্ঠ কর]); কস্য স্বিৎ (কারও); ধনম্ (ধনে); মা গৃধঃ (লোভ করো না)।
সরলার্থ: পরিবর্তনশীল এই জগতে সবকিছুরই ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। তথাপি সব কিছু পরমেশ্বরের দ্বারা আবৃত। ত্যাগ অনুশীলন কর এবং সর্বভূতের চৈতন্যস্বরূপ আত্মায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও। অপরের ধনে লোভ করো না।
ব্যাখ্যা: এই জগৎ এবং জগতের সব কিছু সর্বদা পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। কিন্তু যিনি এই জগৎকে ধরে রেখেছেন তিনি অপরিবর্তিত। তিনি সদা অবিচল। তিনিই পরমেশ্বর। তিনি সকল বস্তুর আশ্রয়। এ জগৎ যেন পর্দার ওপর ফেলা চলমান ছায়াছবি। চিত্র পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু পর্দার কোন পরিবর্তন নেই। একই ভাবে এই দৃশ্যজগৎ পরমেশ্বরের উপর আরোপিত মাত্র, যেমন অন্ধকার রাত্রে দড়িকে আমরা সাপ বলে ভুল করি। সাপের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই। দড়ির কারণেই সাপের অস্তিত্ব এবং আলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই সাপের অস্তিত্ব লোপ পায়। তখন তা দড়িতে লীন হয়ে যায়। সেইভাবেই যখন ব্রহ্মকে জানা যায় তখন এই দৃশ্যজগৎও ব্রহ্মে লীন হয়। তখন আমরা উপলব্ধি করি যে, আমি এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন। এই জ্ঞানলাভই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। এই জ্ঞানলাভের পর জগতের কোন মলিনতা আর আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। চন্দনকাঠ বহুদিন জলে থাকলে তাতে এক ধরনের দুর্গন্ধ হয়। সাময়িকভাবে তার সুগন্ধ চাপা পড়ে। কিন্তু অল্প ঘষলেই সেই গন্ধ চলে যায় এবং চন্দনকাঠের স্বাভাবিক সুগন্ধ ফিরে আসে। সেরকমভাবেই আমাদের জগতের প্রতি যে আসক্তি সেটাও সাময়িক। তা স্থায়ী হতে পারে না। ব্রহ্মরূপে, বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপে নিজেকে চিন্তা করতে হবে। গভীরভাবে নিরন্তর এই চিন্তা করলে সব আসক্তি দূর হবে।
কিন্তু কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব? ত্যাগের অনুশীলন দ্বারা। সর্বদা মনে রাখতে হবে এই জগৎ এবং তার নানা প্রলোভন সত্য নয়; সত্য নয় এই অর্থে যে তা অনিত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, কারণ ব্ৰহ্ম অবিনশ্বর। অনিত্য বস্তুর আকাঙ্ক্ষা চিরতরে ত্যাগ করে ব্রহ্মে মনকে একাগ্র করতে হবে। আমরা সোনা দেখে মুগ্ধ হই, কিন্তু তা নশ্বর। যা ক্ষণস্থায়ী তার পেছনে ছোটা, অপরের ধনে লোভ করা বা নিজের ধনেও আসক্ত হওয়া উচিত নয়। যিনি জানেন এই জগৎ ক্ষণস্থায়ী, তাঁর কাছে ধনসম্পদ ও ইন্দ্রিয়সুখ নিতান্তই তুচ্ছ। ব্রহ্মকেই একমাত্র আকাঙ্ক্ষার বস্তু বলে জানতে হবে এবং ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে হবে। ‘ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং আমিই সেই ব্রহ্ম’, এই জ্ঞান নিরন্তর অন্তরে জাগ্রত রেখে অন্য সবকিছুর প্রতি উদাসীন থাকতে হবে।