যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্যস্যৈষ মহিমা ভুবি।
দিব্যে ব্রহ্মপুরে হ্যেষ ব্যোম্ন্যাত্মা প্রতিষ্ঠিতঃ॥
মনোময়ঃ প্রাণশরীরনেতা
প্রতিষ্ঠিতোঽন্নে হৃদয়ং সন্নিধায়।
তদ্বিজ্ঞানেন পরিপশ্যন্তি ধীরা
আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি॥৭
অন্বয়: যঃ (যিনি); সর্বজ্ঞঃ (সাধারণ ভাবে সব বিষয় জানেন); সর্ববিৎ (বিশেষ রূপে সকল বিষয় জানেন); ভুবি (জগতে); যস্য (যাঁর); এষঃ মহিমা (এইরূপ মহিমা); এষঃ আত্মা হি (এই আত্মাই); দিব্যে (জ্যোতির্ময়); ব্রহ্মপুরে ব্যোম্নি (ব্রহ্মের আবাস হৃদয়াকাশে); প্রতিষ্ঠিতঃ (অবস্থিত); [তিনি] হৃদয়ং সন্নিধায় (হৃদয়ে থেকে); মনোময়ঃ (মনোময়); প্রাণশরীরনেতা (প্রাণবায়ু ও সূক্ষ্ম শরীরের নিয়ামক); অন্নে (অন্নময় অর্থাৎ স্থূল শরীরে প্রকাশিত); প্রতিষ্ঠিতঃ (আশ্রয়স্থল); ধীরাঃ (প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ); তদ্বিজ্ঞানেন (তাঁর সঙ্গে অভিন্নভাবে নিজেকে জেনে) যৎ আনন্দরূপম্ অমৃতম্ (যিনি আনন্দস্বরূপ ও নিত্য); বিভাতি (প্রকাশিত হন); পরিপশ্যন্তি (তাঁরা [আত্মাকে] সম্যক্-রূপে জানেন)।
সরলার্থ: যিনি সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে সব কিছু জানেন, এ জগতের সকল বস্তুই যাঁর মহিমার প্রকাশ, সেই পরমাত্মা জ্যোতির্ময় হৃদয়াকাশে অবস্থান করেন। তাই হৃদয়াকাশের আর এক নাম ব্রহ্মপুর। মন রূপে প্রকাশিত এবং প্রাণ ও সূক্ষ্মদেহের চালক হিসেবে পরমাত্মা স্থূলদেহের অভ্যন্তরে হৃদয়ে বাস করেন। বিবেকী পুরুষরা এই অবিনাশী ও আনন্দস্বরূপ আত্মাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আত্মাকে এইভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তাঁকে সম্যক্ ভাবে জানা যায়।
ব্যাখ্যা: ব্রহ্মকে কি ভাবে বর্ণনা করা যায়? তিনি ‘সর্বজ্ঞ’, সব কিছু জানেন এবং ‘সর্ববিৎ’, সব কিছু বোঝেন। ‘যস্য এষঃ মহিমা ভুবি’—এই বিশ্ব তাঁরই মহিমা। কোন্ অর্থে? এর অর্থ, সকল বস্তুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকেই প্রকাশ করেন। যা কিছু আমরা দেখি সবই ব্রহ্ম। তিনি বাইরে আছেন, আবার ভিতরেও আছেন। তিনি একযোগে বিশ্বগত এবং বিশ্বাতীত। সমগ্র জগৎ তাঁর দ্বারা আচ্ছাদিত। আবার তিনি সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন। ব্রহ্মপুরে অর্থাৎ ব্রহ্মের আবাসে তথা হৃদয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত।
হৃৎপদ্মের মধ্যে রয়েছে শূন্য আকাশ। বাইরেও আছে সেই একই আকাশ। এই হৃদয়াকাশেই ব্রহ্মের অবস্থান। তাই এর নাম ব্রহ্মপুর। হৃদয়াকাশ জ্যোতির্ময় বলে একে দিব্য বলা হয়। আমাদের আবেগ ও অনুভূতিগুলি হৃদয়েই হয়ে থাকে। এই সব অনুভূতির দ্বারাই ব্রহ্মের উপস্থিতি বোধ করা যায়। যোগিগণ ব্রহ্মকে নিজ হৃদয়স্থ আত্মারূপে কল্পনা করেন।
ধরা যাক, কোন ব্যক্তি ব্যবহারিক জগতের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। আসলে তিনি কোথায় গেছেন? কোথাও যাননি। এই জগৎ তাঁর নিজেরই মহিমা, এরূপ তিনি বোধে বোধ করেছেন। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, সমুদ্র সব চক্রাকারে ঘুরছে। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তারা চলে। একই ভাবে দেশকালও নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যাঁর স্বরূপ জ্ঞান হয়েছে, তিনি এই সমগ্র দৃশ্যমান জগতের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। এই জগতের আশ্চর্য সব ঘটনাকে তিনি তাঁর নিজের গৌরব বলে অনুভব করেন। সব কিছুই তাঁর মধ্যে রয়েছে, বাইরে আর কিছুই নেই।